Monday, September 27, 2010

কৌন কহে কব আওয়ে প্রীতম

আজ সকাল সকাল ইমনকে মনে পড়লো। সন্ধ্যার পবিত্রতম কিছু রঙ বুকে নিয়ে যে অস্তরাগরঞ্জিতা অপেক্ষা করে থাকে সূর্য ডুবে যাওয়ার, চন্দনগন্ধি সেই কিশোরীর নাম ইমন। ওর জন্য একটি তার পঞ্চমে, আরেকটি নিষাদে রেখে বাঁধা হয় তানপুরো। জোয়ারী করে তোলা হয় সাঁঝের গাঙ, যার ওপর সে অনায়াসে ভাসাতে পারে তার পালকের মতো ফুরফুরে, মুক্তোর মতো নিটোল আসমানী ময়ূরপঙ্খী।

সন্ধ্যা নেমে আসে। পুব-আকাশে মেঘ সরে যায়, হঠাত করে একফালি চাঁদ দেখতে পেয়ে খুশী হয় কিশোরী। দুচোখে তার কড়ি মধ্যমের বিস্ময় ফুটে ওঠে। ময়ূরপঙ্খীর খোলা ছাদে জাফরি কাটা আলসের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে। আর কতো দেরী? কখন আসবে তার প্রীতম? আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে যে! তবে কি আজ দেরী হবে? হাওয়ায় উড়তে থাকে তার রেশমের মতো সুরেলা আঁচল। জ্যোতস্নায় ধুয়ে যায় তার গা। মনে মনে একান্তভাবে গান্ধারকে ডাকে সে। এসো গহীন, এসো।

অরণ্যের মধ্যে, স্ফটিকের আসনে বসে মালায় প্রহর গাঁথে হেমবরণ, পলাশলোচন শুদ্ধ গান্ধার। অনন্ত প্রেমরসে বিভোর হয়ে থাকে মধ্যরাতের মতো গহীন সেই পুরুষ। গন্ধর্বলোকে তার কাছে পৌঁছয় ইমনের ডাক।
একসময় কিশোরীর বন্ধ চোখের ওপর ভাসতে থাকে শুদ্ধ গান্ধারের ছায়া। ইমনের কাঁপতে থাকা অধরে সে বীণকারের অমোঘ আঙুল রাখে।

ইমনসকাশে গান্ধারকে যেমন করে দেখতে পাওয়া যায়, এমন আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই তীব্র সকালে কেন মনে পড়লো আজ তাদের কথা? আমার রৌদ্রস্নাত, তরতরে ঝরঝরে সকালগুলোও কি আসলে নিবিড় কোনো সন্ধ্যার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে?
হয়তো তাই। এক মায়া-অন্ধকারে মিশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আমাদের অবচেতন। অজান্তে সাধনা করে সেই সময়ের জন্য, যখন কিশোরী ইমনকে বিস্তৃতি দেবে নিষাদ ছুঁয়ে রেখাবের সুর লাগানো গান্ধার আর গান্ধারকে পরম যত্নে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেবে কমলকলির মতো ফুটে উঠতে থাকা ইমন।

Wednesday, September 22, 2010

যাও মেঘ

বর্ষাকালে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটা সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। ঘুটঘুটে ঘন জঙ্গলগুলোয় তো বটেই, পুরোনো পাথুরে বিল্ডিং-এর গা বেয়ে ওঠা ঝাঁকড়া লতা আর পাথরের জোড় বরাবর গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার মখমলি স্তরেও উপচে পড়তে থাকে সবুজ। সবুজ মানে কাঁচা, সবুজ মানে উল্লাস! সবুজ মানে একরত্তির মধ্যে বাঁধা পড়েছে আলো। মনে হয় সবকিছুর মধ্যে এতো এতো প্রাণ আছে!

পাঁচিলের ইঁট, বিল্ডিঙের পাথর, মোটা মোটা কাঠ, কড়িবরগা - সকলেই শ্বাস নেয় তখন। চাইলে ফিক করে হেসে ফেলতে পারে, পড়া বলতে পারে, বলে দিতে পারে কোন রাস্তা ধরে গেলে তুমি ঠিক ঠিক মেইন বিল্ডিং বা জয়কর লাইব্রেরী পৌঁছে যেতে পারো।

মেইন গেট দিয়ে ঢোকার পর বেশ গোলমেলে ঠেকে ভিতরটা। কোন দিকে যাবে? বড্ড বড় ক্যাম্পাস, কোন পথ কোথায় যায় জানতে হলে ম্যাপ দেখে নিতে হয়। এলোমেলো ভুল দিকে চলে গেলে খুব মুস্কিল; ভালো হাঁটতে না পারলে, দিনের দিন পায়ে হেঁটে ঠিক জায়গায় না-ও পৌঁছতে পারো। সেটা বেশ অসুবিধের, আবার হাতে তেমন কোনো কাজ না থাকলে, সেটা দারুণ মজার। মনে হয় জঙ্গলে বেরিয়েছি বেশ, অ্যাডভেঞ্চারে। মনে হয়, বাঘ না হোক, হরিণ-টরিণ পেয়ে যাব।

হাঁটো, হাঁটো। কতো গাছের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। সরু সরু রাস্তা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। জঙ্গুলে পাকদণ্ডীও আছে, তাদের সুলুক-সন্ধান জানা থাকলে সেদিকে যাওয়া যায়, জোঁকের কামড় খাওয়া যায়। মেডুসার চুলের মতো বুড়ো বটের ঝুরি নেমে আসবে তোমায় ঘিরে, ছুঁয়ে ফেলবে গাল। মিঠে রোদে পড়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন গাছের গা বেয়ে উঠেছে পানপাতার মতো পাতাওলা এক বল্লরী। দেখবে তার পোশাক থেকে কোঁচকানো চুলের মতো অসংখ্য সবজেটে সুতো নেমে এসেছে। গাছেদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা তুলেছে আশপাশের সকলকে ছাড়িয়ে। চিরউন্নত বিদ্রোহী শির। বিদ্রোহীদের মধ্যে দেখা হয়ে গেলে তারা কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঝিরিঝিরি চাঁদোয়া তৈরী করে ফেলে। এভাবে কোথাও কোথাও বন্দী হয়ে থাকে আকাশ। এই ঘন পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসে হিরের আংটির দ্যুতির মতো।

বটের গুঁড়িতে ঘন সবুজের আস্তরণ, পায়ের কাছে কাদা হয়ে আছে মাটি। সাদা সাদা রসালো ব্যাঙের ছাতা উঠেছে তার পাশে, ইতস্তত বসে আছে খেলনাবাটি সাজিয়ে। ছাতার গায়ে পুটিপুটি দাগ। ঘুঙুরের শব্দ পেলে? পাশেই তো সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট। ললিত কলা কেন্দ্র। নাচ শেখা চলছে ওই দিকটায়। হাতে তালি দিয়ে দিয়ে বোল বলছেন কেউ, তার সঙ্গতে ঝমঝম বাজছে ঘুঙুর, বাজছে চঞ্চল পায়ের পাতা। সেই ছন্দময় শব্দ মৃদু এক গুঞ্জনের মতো ভেসে আসতে থাকে। মিশে যেতে থাকে পাতা কাঁপিয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, পাখি আর পোকার শব্দ, ভ্রমরের শব্দের সাথে।

মস্ত বড় পুকুর আছে, অযত্নলালিত। পুকুরে পাতা ভাসে, পদ্ম ফোটে, হাঁস চরে। পুকুরের কাছেই আছে বড়সড় একটা পার্ক। এখানে বসে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে একটা বেলার পাতা নিশ্চিন্তে উলটে দেওয়া যায়। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বত্থ, বট, গুলমোহর। আছে অমলতাস, নিম, কাঠগোলাপ, শিউলি। মাঝবর্ষা থেকেই শিউলির ফুল ফোটানো শুরু হয়ে যায়। বেঞ্চিতে বসে বসে অনেক পাখির ডাক শোনা যায়। চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেউ কেউ, খাবার খুঁজে বেড়ায়। কেউ কেউ শুধু অলস বসে থাকে, উঁচুমতো একটা ডাল বেছে নিয়ে শিস দিয়ে বেলা কাটায়।

শহরের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী কম থাকে ক্যাম্পাসের তাপমাত্রা। ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে থাকে। শীতকালের দুপুরবেলায় গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে শিরশির করে গা, সোয়েটার পরা থাকলেও। স্কার্ফ রাখতে হয় সঙ্গে। বিকেলের পর থেকে হিম পড়ে একটু একটু করে। শীতের দিনে বদলে যায় ক্যাম্পাসের রঙ। বর্ষাকালের মতো রাজকীয় বিন্যাস আর থাকেনা তার। পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোকে বড় বিষণ্ণ দেখায়। শুকনো, স্থবির। ভালো লাগে না। তাই শীতকালে পারতপক্ষে এদিকে বেড়াতে নিয়ে আসি না কাউকে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি পেরিয়ে এলাম, অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট। আজকের মধ্যে পুরোটা দেখা সম্ভব না। মেইন বিল্ডিঙের পরে আরো অনেকখানি আছে। অনেকগুলো মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্কুল, হস্টেল, জঙ্গল। তারও পরে আছে বেশ কিছু অফিস, ওপাশে কয়েকটা রিসার্চ ইন্সটিট্যুট, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, জলের ট্যাঙ্ক, মাঠ, জঙ্গল। সে অনেক দূর। কোথায় যাবে এবার? চা খাবে? ক্যান্টিন চাই? ওই তো। এখান থেকে একটুখানি। অবেলায় পেট ভরে খেতে চাইলে ছাদওয়ালা ক্যান্টিনটায় যাও। পাব্লিকেশন ডিপার্টমেন্টের পাশে। খুব পুরোনো সব বাড়ি। অচেনা এক বুনো ঝোপের গন্ধ আসে। ঘুম ঘুম ঠাণ্ডা কালচে পাথর আর ভিজেমাটি মেশানো গন্ধ। বাঁশের কঞ্চি কেটে চাটাইয়ের মতো ক্রিসক্রস বুনে ঘিরে রাখা আছে নিচু টানা-বারান্দাগুলো। কতোকালের চিহ্ন লেগে আছে এদের গায়ে। কাছে গেলে মনে হতে থাকে সেইসব কালে যেন পা পড়ে গেলো।

কুপন কেটে চা আর খাবার নিতে হয়। এখানকার খাবার বেশ সস্তা। সাবসিডাইজড রেট কিনা কে জানে। আয়েস করে খাও। দেখতে দেখতে মেঘ ক’রে বৃষ্টি নামলো। এখন বেরোনোর উপায় নেই। বরং ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসো, যার উল্টোদিকের টেবিল ঘিরে পার্ট-টু’র ছেলেমেয়েরা থিয়েটারের গল্প করছে। একটু পরে ওদের রিহার্সাল শুরু হওয়ার কথা, ধুম বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেছে। কাঠের টেবিল, প্লাস্টিকের চেয়ার, রঙচটা ডিশ। আবার হয়তো অনেকদিন পর এদেরকে মন দিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।

বৃষ্টিতে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে সামনের রাস্তাটা। ওই রাস্তাটাই শাখানদীর মতো ভেঙে ভেঙে চলে গেছে এদিক সেদিক। যেতে যেতে হরেক দূরকে এনে দিয়েছে এতোখানি কাছে, আবার সময় ফুরোলে নিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর।


---

(পুণা ইউনিভার্সিটির কথা)

Tuesday, September 14, 2010

পুষ্পা

প্রচণ্ড বাজে বকতো মেয়েটা। রুমে থাকলে বকে বকে আমার মাথা খেতো। দুর্বোধ্য সব কারণে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়তো আমার বিছানায়। আমি দেখতাম ওর ছোট ছোট কালো চুলে বেগুনী ক্লিপ, ফর্সা গালে ব্লাশ-অন। বড় বড় শেপ করা নখে লাল নেলপলিশ লাগানো। ঠোটে একই রঙের ম্যেবেলিন-রঞ্জনী, গাঢ় করে লেপা। এত বেশী লাল ভাল্লাগতো না আমার। বাড়াবাড়ি। প্রায়ই তাড়াতাম ওকে ঘর থেকে। পুষ্পা তুম যাও অভি, প্লিজ যাও। কী ভাগ্যি ও বেশীক্ষণ হস্টেলে থাকতো না।



কোনো দরকারে ওর সঙ্গে বেরোনোটা ছিল ভয়ানক মুস্কিলের ব্যাপার। নানারকম ছাপছোপ মারা মিনি স্কার্ট পরে হেলেদুলে হাঁটবে পুষ্পা। ঝকমকে বুটস পরবে। কটকটে লাল টপের ওপর তালিমারা ম্রিয়মাণ ডেনিম জ্যাকেটের চেন যদি বা বন্ধ রাখবে, মুখ বন্ধ রাখার কোনো গল্প ছিলোনা ওর। অদ্ভুত সব বোকা বোকা কথা চেঁচিয়ে বলতে বলতে, জোরে জোরে হাসতে হাসতে যেতো সারাটা রাস্তা, উত্তর না দিলে একাই বকে যেত। কী আপদ! খুব স্বাভাবিকভাবেই পথচলতি মানুষের নজর যেতো ওর দিকে। ভেসে আসতো উড়ো কমেন্ট, যার সবকটাকে খুব শ্লীল বলা চলে না। কমেন্ট এসে আবার মাটিতে পড়তে পেতো না, কানে গেলেই ক্ষেপে উঠতো পুষ্পা, শানানো উত্তর দেওয়া শুরু করে দিতো। কী দরকার তোর উত্তর দেবার? হোপলেস। এতো অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ার করিস কেনো তুই?



ও বুঝতে চাইতো না। পিত্তি জ্বলে যেতো আমার। এরকম দু-একটা অভিজ্ঞতা হওয়ার পর ভুলেও বেরোতাম না ওর সঙ্গে। ও কাকুতি-মিনতি করলেও কড়াভাবে নাবলে দিতাম। মনে মনে ততদিনে ওকে দাগিয়ে দিয়েছিলাম বখে যাওয়া মেয়েহিসেবে। পুষ্পা ছিল মণিপুরী। হিস্ট্রি নিয়ে বি এ পড়তো নৌরোসজী ওয়াড়িয়া কলেজে। কলেজটা নামকরা। কীভাবে চান্স পেয়েছিলো, এনরোল্মেন্ট-টাই বা কেমনকরে টিকিয়ে রেখেছিল জানা নেই আমার। পড়াশোনা অল্প-স্বল্প করতো ঠিকই, কলেজ যেতে খুব একটা দেখতামনা ওকে



সকাল হতে না হতেই ওর দড়িবাঁধা (নইলে স্পিকারের সামনেটা খুলে আসতো) স্টিরিওটায় মারাত্মক সব ভজন চালাতো পুষ্পা। গোবিন্দ বোলো হরি, গোপাল বোলো!! গোপালা গোপালা রে, পেয়ারে নন্দলালা। তবে রে! আশেপাশের রুম থেকে ছুটে আসতো মেয়েরা। কেউ একজন ওর প্লেয়ারের সুইচে থাবড়া মেরে বলতো “এ বন্দ কর তেরা ইয়ে রোজ রোজ কা নাটক! সোনে দে।” পাগলের মতো ঝগড়া শুরু করতো পুষ্পা তখন। কিছুতেই ওর ভজন বন্ধ করবে না। বাধ্য হয়ে কম্বল ছেড়ে উঠতাম আমি, চেঁচাতাম। “পুষ্পা! কী হচ্ছে কী সকাল সকাল, বন্ধ না করিস, আওয়াজটা কম কর। কানে লাগছে তো সবার!” কেন জানিনা একটু হলেও আমার কথা শুনতো এই অবাধ্য, ঝগড়ুটে মেয়েটা। মেয়েরা গজগজ করতে করতে চলে যাবার পর আমার দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞভাবে বলতো, সুবহা সুবহা ভগোয়ান কা নাম লেনা চাহিয়ে না? ইয়ে লোগ নেহী সমঝতে হেয়! “নহী সমঝতে” র লিস্ট থেকে আমাকে কেন বাদ দিতো ওই জানে।



অপার ভক্তি ছিল পুষ্পার। সোমবার শিবের উপোস। বৃহস্পতিবার গনেশজীর। লেগেই থাকতো। দরজায় নক করে প্রায়ই পেঁড়া দিতে আসতো আমাকে। মুখে হাসি। “সবকো নাহি দেঙ্গে হম। সির্ফ তুমহে, সারিকাদিদিকো ঔর লক্ষ্মীদিদিকো দেনা হেয়। বাকি সারে লড়কিয়াঁ মুঝে খারাব বোলতে হেয়। সব সালে সুয়ার কে ঔলাদ”। আঃ, পুষ্পা! ওকে থামাতাম আমি। এতো গালি দিস কেনো তুই? মন্দিরে পুজো দিয়ে এলি কিসের জন্য? কী লাভ হচ্ছে তোর? উল্টোপাল্টা কথা বলা ছাড়বি না, ঐরকম সাজবি তো খারাপ-ই বলবে সবাই। বেশ করবে। হিম্মত থাকে তো শোন। গালি দিচ্ছিস কেন? রেগে যেতো পুষ্পা। পেঁড়াটা ধরিয়ে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করতো, তুমি কী জানো! আমার জাত নিয়ে, ইজ্জত নিয়ে কথা বলে ওরা। ‘চিঙ্কি’ বলে আমাকে, ফ্যামিলি তুলে জোক মারে তা জানো। আমি নাকি খারাপ মেয়ে। কী জানে ওরা? কী জানে? আমার বাবা আর্মিতে, দাদু আর্মিতে ছিলো। আমরা বৈষ্ণব, তা জানো? আমাদের বাড়ির কালচারই আলাদা। আমি কথা বলতে ভালোবাসি, সাজতে ভালোবাসি তাই...” ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করে দিতো। হাইপার মেয়ে ছিলো পুষ্পা। খুব একটা সুস্থও ছিলোনা।



“যা ঘরে যা, কেউ শুনতে পাবে, আর ঝগড়া বাধাস না”। ও চোখ তুলে তাকাতো হঠাত “মুঝে আলা কি ইয়াদ আতি হেয় তো ম্যায় মন্দির চলি যাতি হুঁ। মেরা আলা কিঁউ ছোড়কে গয়া মুঝে!” উফফ, আবার সেই এক কথা!



এই আলা নামের রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি, আল্লাহ-কে আলা বলতো কিনা জানিনা। এই নামে পুষ্পার একটি বয়ফ্রেণ্ড ছিলো। শুনেছি সে প্যালেস্টাইনের ছেলে, পুণার সিম্বায়োসিস ইন্সটিট্যুটে পড়তে এসেছিলো। তার সঙ্গে নাকি পুষ্পার আলাপ হয়েছিল পুনের এম জি রোডে কোথাও, এবং আলাপ হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই আলার সঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনশিপে যেতে কোনো আপত্তি ছিলোনা পুষ্পার। এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে ওয়াড়িয়া কলেজের আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট গার্লস-হস্টেল ছাড়তে হয়েছিলো, পার্ট টাইম কাজ নিতে হয়েছিল একটা কসমেটিক শপে। বাড়িতে কী বলেছিলো কে জানে! আলা যে ভিনদেশী মুসলিম ছিলো, তা নিয়েও কোনো মাথাব্যথা ছিলোনা গোঁড়া হিন্দু পুষ্পার, অন্তত আমি দেখিনি। ভালো করে চেনা নেই শোনা নেই একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে কেনো থাকতে চলে গেছিলো জিজ্ঞেস করলে সহজ উত্তর পাওয়া যেতো, উসসে বহোত পেয়ার করতি থি ম্যায়। বোঝো।



শুনেছি নিজের কোর্স শেষ হয়ে যাবার পর চাকরী নিয়ে দুবাই চলে গেছিলো আলা। পুষ্পাকে নিকাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছিলো যাবার আগে। সে নাকি বলেছিলো, বছরদুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে পুষ্পাকে বিয়ে করে নিজের দেশ প্যালেস্টাইনে নিয়ে যাবে। আলা চলে যাবার পর প্রথম দু-এক মাস ফোনে আর ইন্টারনেট-চ্যাটে কথা হতো তাদের। ধীরে ধীরে কমতে কমতে একদিন সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। ফোন নাম্বার পালটে নিয়েছিলো আলা। কোনো ই-মেলের জবাব আসতো না আর। পুষ্পা বিশ্বাস করতে পারতো না আলা তাকে ঠকিয়েছে, স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছে তাকে। ও কেবল ভাবতো আলার হয়তো কোনো বিপদ হয়েছে। পাগলের মতো যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যেতো ও, আলার বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ করতো। এভাবে খোঁজ করতে করতে একদিন রাত্রে কারোর কাছে পুষ্পা খবর পেলো, আলা নাকি আসলে বম্বেতে আছে, বোরিভলীর কাছে কোথাও দেখা গেছে তাকে। অপরিণামদর্শী, বেপরোয়া পুষ্পা সেই রাত্রেই বেরিয়ে পড়েছিলো আলার এক পুরোনো ক্লাসমেট হায়দারের সাথে, বাইকে। সদ্য নির্মিত মুম্বই-পুনে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে তীব্রগতিতে যেতে যেতে বাইকটি এক্সিডেন্ট করে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় হায়দার, মারাত্মক জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় পুষ্পা।



একটি হাত, একটি পা আর জ’বোন বা ম্যাণ্ডিবল টুকরো হয়ে গেছিল পুষ্পার, মাথায় গুরুতর আঘাত ছিলো। চারবার সার্জারি ও আড়াই মাস হাসপাতালে থাকার পর মণিপুরের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুষ্পাকে। এর প্রায় বছরখানেক পর, পুণায় ফিরে গিয়ে কলেজের পড়াশোনা চালু করার জন্য বাবা-মায়ের কাছে বারবার অনুরোধ করতে থাকে সে। সকলের অমতেই এই দ্বিতীয়বার পড়তে আসা তার। এসব ঘটনা ওর মুখেই শুনেছিলাম। অজস্র সেলাইয়ের দাগ দেখেছিলাম ওর মাথায়, হাতে, পায়ে। মেসের খাবার খেতে পারতো না ও, রান্না করে খেতো। রুমের এক কোণায় স্টোভ জ্বালিয়ে রাঁধতো। এমনিতে রুমে কোনোরকম আগুন জ্বালানোর অনুমতি ছিলোনা, শুধুমাত্র ওর অবস্থা বিবেচনা করে ওকে স্পেশাল পার্মিশন দিয়েছিলো হোস্টেল অথরিটি। ওর রুমের সামনে দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার দেখেছি, এক হাতে নোটস, অন্য হাতে খুন্তি নিয়ে জোরে জোরে পড়তে পড়তে পায়চারি করছে পুষ্পা। একপাশে কড়াইতে ঝোল বা খিচুড়ি টাইপের কিছু ফুটছে।



হস্টেলে থাকার সময় একবার ভাইরাল ফিভার হয়েছিলো আমার। হঠাত করেই অনেকটা জ্বর উঠে গেছিলো। এই অর্ধ-উন্মাদ মেয়েটা লক্ষ্মীদিদির কথামতো সারারাত জেগে বসেছিল আমার বিছানার পাশে। জলপটি দিয়েছিল, প্রেস্ক্রিপশন আনুযায়ী ওষুধ এনে খাইয়েছিলো হাতে করে। কদিন ওর স্টোভেই রান্না হয়েছিল আমার পথ্য। অনেক বাধা দেওয়া সত্বেও জোর করে বেশ কয়েকবার কেচে দিয়েছিল আমার জামাকাপড়। প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীদিদি পেশায় ডাক্তার ছিলো, সসুন হাসপাতালে এম ডি করছিলো তখন। লক্ষ্মীদিদিও কল্পনাতীত যত্ন নিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলো আমায়। বাইরের কোনো ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অসুখের সময় পুষ্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “কেনো এতো যত্ন করছিস বলতো? আমিতো শুধুই বকাবকি করি তোকে”। জ্ঞানপাপীর মতো উত্তর দিয়েছিলো “ম্যায় কাম হি এয়সা করতি হুঁ না, ইসলিয়ে ডাঁটতি হো। কেয়ার করতি হো, তভি না ডাঁটতি হো”। সত্যিই হোপলেস কেস।



হোস্টেল ছেড়ে চলে আসার আগে পুষ্পা আমার ঠিকানা লেখার ডায়রী চেয়ে নিয়ে তাতে যত্ন করে ওর সমস্ত পার্থিব ঠিকানা লিখে দিয়েছিলো। বলেছিলো, চিঠি দিও, এসো আমার মণিপুরের বাড়িতে। চিঠি দেওয়া হয়নি আমার, আর কখনো দেখাও হয়নি ওর সাথে। আমি জানি ওর সঙ্গে আমার ঠিক বন্ধুত্ব ছিলোনা। কোনোদিন ঠিক ভালোবাসিনি ওকে। উলটে কোনো কোনো সময় ওকে দারুণ অপছন্দ করেছি, এড়িয়ে চলেছি। তবু আজ ওর কথা লিখছি কারণ এমন অদ্ভুত নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে খুব কম মানুষকে দেখেছি।



পুষ্পা সুন্দরী ছিলো। বেশ সুর ছিলো গলায়। যেদিন ওকে রুম থেকে চটপট তাড়িয়ে না দিতাম, হেসে হেসে দুলে দুলে গান গেয়ে শোনাতো- অজীব দাস্তাঁ হেয় ইয়ে, কাহাঁ শুরু কাহাঁ খতম। ওর আলা নাকি ওর গলায় এই গানটা শুনতে চাইতো। সে নাকি চাইতো ও সবসময় সাজগোজ করে থাকুক তাই পুষ্পার জন্মদিনে ওকে খুব দামী একটা মেক-আপ বক্স কিনে দিয়েছিলো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, এতকিছুর পরেও মেয়েটা রাগ করতে পারতো না ঐ বিশ্বাসঘাতকের ওপর। নাছোড় এক শিশুর মতো বিশ্বাস করতে চাইতো আলা একদিন ফিরে আসবে ওর কাছে। আফসোস করতো সেবার বম্বে গিয়ে খোঁজ করতে পারেনি বলে। যেন ওর এক্সিডেন্টটা কিছুই ছিলোনা। হায়দারের মৃত্যুর জন্য অবশ্য নিজেকে ও দায়ী করতো মাঝে মাঝে। তারপর, পাখির নীড়ে ফিরে আসার মতো, ফের শুরু হতো ওর প্রেমিকপ্রবরের কথা



ওর মুখে আলা-নাম শুনতে পেলেই হস্টেলের মেয়েরা হয় দারুণ চটে উঠতো নয় ওর মুখের ওপর হাসতে শুরু করে দিতো। বলতো, আরে পুষ্পা তেরা আলাওয়ালা কিসসা কবকা খতম হো গিয়া। অব কোই নয়া কিসসা শুরু কর, খুশ রহেগী। মুখটা শুকিয়ে যেতো পুষ্পার, তাড়াতাড়ি বলে উঠতো তোমরা আমার আলাকে চেনোনা তাই, ও যেদিন ফিরবে...



(শেষ)

Saturday, September 11, 2010

বাসা

আর মাত্র ক'টাদিন রাতের এই ঘ্রাণ

তারপর এ শহর ফেলে যেতে হবে

এই ঘর, এই গাছ

সবুজের জল পাওয়া বাড়ি

যেখানে যেখানে প’ড়ে আনন্দ-রেখাবের দাগ

ঘুম ভেঙে যে পাতারা টুপটুপ মৃদুশব্দে

রাত্রির বৃষ্টিকথা বলে

যে উদাসী বারান্দায় গুটিসুটি শুয়ে থাকে

মেঘভাঙা উত্তরের রোদ

সেসব মায়াবী চোখে চোখ রেখে

একদিন, আরেকদিনের মতো

ভালোবেসে চলে যেতে হবে

Saturday, July 31, 2010

স্বগতোক্তি

শব্দেরা দিয়ে চলে ঠেকনাই
শব্দহীনতা থাকে আড়ালে
ছন্দবিলাসী কিছু চেকনাই
ধরা পড়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে

গাছের ছায়ার মতো নির্মাণ
হারিয়েছে কবিতারা আজ কি?
কবিতায় কলমের মনপ্রাণ
পড়ে নেই, পড়ে শুধু সাজ কি?

খুলে রাখো কবিতার আয়োজন
তোমার ত্বকেই আছে বেশবাস
তোমার খাতায় থাক আলোড়ন
আরোপবিহীন কিছু নিঃশ্বাস

জ্বর

এই তো আমার সাবেক কালের ঘর
যেখানে ঘর, কান পাতলেই সেখানে বন্দর।


সব জ্বর একদিন না একদিন ছেড়ে যায়। সেবার যখন জ্বর হয়েছিলো, আর সকলের মতো আমিও ভেবেছিলাম সারবে না কোনোদিন। এই শেষ। এইবার একটা এসপার- ওসপার না হয়ে যাচ্ছেনা। ভয়ে ভয়ে আছি আর কোথা থেকে একটা চোরা আনন্দ এসে সব গোলমাল করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই মাপছি- ও বাবা এতো! আমার কপালে এত জ্বরও থাকতে পারে! কিছুই রুচছে না মুখে আর সবার সাথে কথায় কথায় ঝগড়া হয়ে যাচ্ছে। উত্তাল ঝগড়া করছি আর ভাবছি এটা কি বিকার? এরকম কেন হচ্ছে আমার! এরকম সবার হয় নাকি?

চুপি চুপি খোঁজ নিতে লাগলাম। জোর রক্ত পরীক্ষা টরিক্ষা। সিম্পটম মিলে যেতে যেতে শেষে দারুণ বাড়াবাড়ি হলো। ভয়, ভাবনা কিছুই তেমন নেই আর। ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে।
নিজের নাড়ী ধরে বসে আছি, সবকিছুর মধ্যে এই এক জ্বালা হয়েছে। কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। জ্বরের সঙ্গেই তখন আমার একমাত্র যোগাযোগ। এই সময় একদিন কিছু কিছু স্বর আমায় ছেড়ে চলে গেলো কৈশোরের সরলতার মতো। নাকি আমি ছেড়ে এলাম তাদের? ঠিক বুঝতে পারলাম না। সেই সব কোমল স্বরের জন্য দুঃখ হলো। পাহাড়-অরণ্যের কিছু স্বপ্নও গেলো ছেড়ে। কচি লাউয়ের মতো সবুজ স্বপ্ন, ফায়ারপ্লেস আগুনের মতো গনগনে।
সারা দুপুর পায়রাদের ওড়াউড়ি দেখি পাশের বাড়ির কার্নিশে। দেখি কথা চিনতে পারিনা কারো। শব্দগুলো ভোঁতা ভোঁতা হয়ে কানে ঢোকে, কোন ছবি হয়না। কেমন যেন একা হয়ে গেলাম।
তাও আমি কাটাচ্ছিলাম বালিশে ঠেস দিয়ে, জ্বরের পাণ্ডুলিপি পড়ে পড়ে।
তারপর একদিন ঘাম দিয়ে ছাড়ার মতো হল। জ্বরের অভ্যাস ছিলনা, আবার ভয় পেলাম। এক পা এক পা করে এগোচ্ছি আর খারাপ লাগছে। অপরাধী লাগছে। নির্বোধ। এই জ্বর তবে শাশ্বত ছিলনা? এইভাবে জ্বর সেরে যায়? এত উত্তাপ মিথ্যা ছিল তবে! অবিশ্বাস্য লাগছিলো।
কাঠ-কয়লা দিয়ে হিজিবিজি লিখি, মুছেও ফেলি তাড়াতাড়ি। তারপর দেখতে দেখতে সব তপ্ত পোশাকের রঙ ফিকে হয়ে এলো। পাণ্ডুলিপি থেকে শুকিয়ে এলো বর্ষার জল। দেখতে দেখতে পুরোনো হলো সব গভীর সৌন্দর্যময় শীলালিপি। সব আশ্লেষ, মনোযোগ।
ধুলো পড়ে এলো শোকে, রেডিওতে। সেই সব গান আর বাজেনা কোথাও। অবাক ও বিষণ্ণ চোখে পৃথিবীর দিকে তাকালাম আবার। কপালে হাত দিয়ে দেখি- ঠাণ্ডা মতন লাগে। তারপর জ্বর সেরে গেলো আর সেটা বিশ্বাসও হলো আমার। শুধু কতগুলো ঘোর লাগা দিন আর রাত্রি বাঁধা পড়ে আছে জ্বরের কাছে, কোথায় যেন।

Thursday, July 29, 2010

ক্ষণভঙ্গুর

বললে বিশ্বাস করা শক্ত, এই বিল্ডিং এর কাউকে চিনিনা আমি অথচ এখানে আছি অনেকদিন ধরে
চিনিটা, তেলটা ফুরিয়ে গেলে চাইতে যাওয়া যায় এমন একটাও পড়শী নেই এখানে আমার এখানে কেন, কোত্থাও নেই
অথচ আমি জানি কয়েক ধাপ নিচের অ্যাপার্টমেন্টে কাজ চলছে এত এত ড্রিলিং করে, সারাদিন ধরে ঘষে ঘষে কী তৈরী করছে বা নষ্ট করে ফেলছে জানিনাতবে হচ্ছে বড়সড় কিছু একটা
সামনের করিডোর বা আশেপাশের সিঁড়িগুলোকে তাই রুগ্ন দেখায়, যেন ক্রনিক অ্যানিমিয়ায় ভুগে ভুগে সাদা হয়ে গেছে
এখানকার রান্নাঘরের জানালার উল্টোদিকে যাদের জানালা তারা খুবই হিং ও কারিপাতা বিলাসী মাঝে মাঝে ঘি দিয়ে কিছু রাঁধে, গন্ধে দারুণ খিদে পেয়ে যায় তাড়াতাড়ি আলো নিভে যায় ওদের রান্নাঘরে
আবার রোজ সকাল সকাল রান্না চাপিয়ে দেয়, কি শীত কি গ্রীষ্ম ছ'টা বাজতে না বাজতেই প্রেশার কুকারে হুইসল পড়তে থাকে একদিন শুনি রাত বারোটায় হুইসল পড়ছে, অবাক হয়েছিলাম
এদের ঠিক নিচে যাদের খাবার ঘরের জানালা, তাদের বাড়িতে একটি ছোট্ট মেয়ে থাকে ময়নাপাখির মতো সারাদিন আধো আধো মারাঠীতে বকর বকর করতে থাকে সে একদিন লোডশেডিং এর সময় শুনেছিলাম সে তার মাকে জিগ্যেস করছিল মোমবাতিটা (এরা বলে মেমবাত্তি) খালি ছোট হয়ে যাচ্ছে কেন? কে নিয়ে যাচ্ছে? ময়নাপাখির মা সন্ধ্যা হলেই সজোরে হিন্দি সিরিয়াল চালিয়ে দেন আর রাতের দিকে কখনো লোডশেডিং হলে যিনি গান ধরেন তিনি সম্ভবত ময়নাপাখির বাবা তাঁর গলায় কিশোরকুমার ছাড়া আর কারো গান শুনিনি, নির্ঘাত ফ্যান মন্দ নয় কিন্তু গলাটা, বেশ সুরে তবে ওঁর পুঁজি অল্প, তিনটে গান রিপিট হতে থাকে
একদিন বৃষ্টির সময় দেখি ময়নাপাখিটা জানলা দিয়ে একটা কাপ বাড়িয়েছে বৃষ্টি ধরবে বলে!
এদের নিচের অ্যাপার্টমেন্টে একটি বাঙালী পরিবার থাকে যেদিন তাঁদের শুঁটকি মাছ রান্না হয় সেদিন সমস্ত জানালা ভালো করে বন্ধ করেও গন্ধের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়না আজ অব্দি চোখে দেখিনি ঐ পরিবারের কাউকে, টুকটাক বাংলা শব্দ ভেসে আসতে শুনেছি একদিন গানও শুনেছি- মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি!
বারান্দায় দাঁড়ালে কয়েকটা গাছের আড়ালে যাদের বারান্দা দেখা যায় তাদের রেলিং থেকে লম্বা লম্বা শাড়ি ঝোলে বারান্দায় শাড়ি ঝুলতে খুব একটা দেখা যায়না আজকাল তাই চোখে পড়েছিল একদিন বৃষ্টি নামার ঠিক আগে একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি করে তুলছিলো শাড়িগুলো, তার হাতের কাচের চুড়ি ঝিনিক ঝিনিক বাজছিল বেশ
কাচের চুড়ির মতো রিস্কি জিনিস হাতে পরে এরা নিশ্চিন্তে দিনের এত কাজ কিকরে করে যায় কোনোদিন ভেবে পাইনি

Thursday, May 6, 2010

সপ্তপদী

তুমি আমায় কী দেবে না
তা ভেবে আজ পা ফেলা নয়

দিদি ভীষণ মার খেয়েছে
হাতের তেলোয় কালশিটে আর
আতঙ্ক ওর

দেখলে আমি শিউরে উঠি
তবু শিকল খুললো না ও একটিবারও |


দিদি আমার ক'দিন পরে
চলেও গেছে এক কাপড়ে
আর কোত্থাও যাবার জায়গা পায়নি ব'লে
সাহস বেঁধে অন্ধকারে
মিলিয়ে গেছে


রুপোর নূপুর তবুও আমি যত্নে পরি
কল্কা আঁকি, জলকে চলি, চলকে পড়ি
টুকরো হতে

বদলে যাওয়ার শর্ত রাখা কঠিন স্রোতে

আচ্ছা শোনো,

আমায় তুমি রাগিয়ে দেবে?
তারপরে খুব
ভুলিয়ে দেবে, হাসিয়ে দেবে?
ভাসিয়ে দেবে গহীন জলে?
রাখবে বুকে সত্যি করে
একপশলা তোমার বলে?

আমারো তো দিতে চেয়েই শঙ্কামাখা
রাত্রিগুলো ভোরের দিকে জাগিয়ে রাখা

অবিশ্বাসেই ফাটে যদি আমার মাটি
তুমিই বলো
রাখব কোথায় ভরসা আমার ?
পুঁতবো কোথায় স্বপ্নগুলো !

Wednesday, January 6, 2010

সুয়োরাণীর চিঠি

রাণী আমি, জানোইতো। রাজধানী ছেড়ে,
যাবার উপায় নেই। নইলে হয়ত-

কটাদিন সত্যি সত্যি
জঙ্গলে-উপত্যকায় দুবৃত্তের মত
কাটাতাম তোমার সঙ্গে।
যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা হত, দারুণ লুঠপাট!

ধান-দূর্বা ফেলে দিয়ে,
নীল বসন উড়িয়ে দিতাম ঝড়ে,
মেখে নিতাম
পলাশরঙা ধুলো আর
আমার শিকার করা দেখে তুমি গোপন ঈর্ষায়
পাগল হয়ে যেতে-
ঝলসে নিতাম মাংস
গুহায় আগুন জ্বেলে,
চাখতে চাখতে পুড়িয়ে ফেলতাম ঠোঁট-
(রাজভোগে কখনো অসহ্য
কোন স্বাদ থাকেনা; ওগুলো গুজব।)
তছনছ করা যেত একটা
সাবেকী রুপকথা।
বেশ হোত, বেশ হোত- তাইনা ডাকাত?

'কটাদিন' কেন?

বুঝবে না, রাজ্যপাট নেই তোমার

বেশীদিন পাশাপাশি- খেলা নয়,
আসল যুদ্ধ হবে। দুলে দুলে উঠবে
পায়ের তলার মাটি।
পরস্পরের রক্ত লাগবে হাতে।
ওসব শিরদাঁড়ার ক্ষত, কোনোদিন সারেনা।

ভয় দেখাচ্ছি?
ভয় পাচ্ছি বলো। ক্ষয়ে যাওয়াকে বড় ভয় হয়।
আবার একটা দম-চাপা যুদ্ধ আর
তারপরের সাতমহলা চুক্তি-
ঐ শান্তির কথা ভাবতে পারিনা।

তাছাড়া, একটা ভুল হচ্ছে
তোমার। আমার রক্তের রঙ নীল, মনে রেখো।
এই রাজ্যের ভালোমন্দও সব আমাকেই দেখতে হয়।
--------------

(সুয়োরাণীর চিঠি)

How do I do?

Recently, I've raved a lot about our trip to Mahabalipuram and Pondicherry in my correspondences. It was wonderful indeed. Now that we're back to Pune, I must try concentrating in things that I must do. Time is, but priceless.

I need to work hard, pretty hard. I feel hungry.
I feel less focused and lack discipline. That's not the way to live this life, perhaps.

They say, "Be more concerned about your character than with your reputation, because character is what you really are while reputation is merely what others think you are."

and, I shouldn't fool myself.

Sob Choritro Kalponik



Hna 'Sob Choritro Kalponik' er Idea ta mondo chhilona... touching, kothao kothao hoyto identify kora jaye.... kintu Execution Ta mosto boRo JHUL.

Prasenjit, Bipasha, Jishu eder keno newa hoy tar uttorta hoyto sohoj, Baajaar ke khushi korte. Kintu prothom proshno Rituporno ki puropuri sei kajTa kortei film toiri koren?

Sekhetre, bhalo ekta Screenplay jole debar dorkar chhilona.

Screen play Ta bhalo chhilo, sombhabona chilo... oboshyoi aro kichu editing aro anek bhabna-chintar dorkar chhilo Bipashar Character take niye, tar dialogue/ monologue gulo niye, tar Swopno gulo niye... In fact sobkoTa character ke niyei eta korar dorkar chilo... boddo kNacha kaaj bole mone hoyeche anek jayegay. MoTa daager kaaj.

tabe, Bipashar Saree gulo darun bhalo chhilo protyekTa.

ar Bipashar character er mukhe Onorgol khoi-foTa angrezi.
Bangla sahityo theke joto dure rakha jaye ar ki... ekjon engineer- arekjon Jamshedpuriya Bong.
Jotota boiporityo toiri kora jaye... chesta korechen porichalok. kintu dNaRalona.

Somporko, somporker shades, joTilota, TanapoRen niye kaaj koraTa emnitei Sohoj kaaj noy...
Swopner somporker songe baastober somporker protidinkaar je songhaat, tar theke uThe ashe je jontrona ebong jeta sudhu facial expression e prokash pabar jinis noy... kichchu temon foTeni kothao sebhabe.

Ekjon manusher bhalobasa (doya-maya-samobedona-empathy r moto bepar noy, Bhalobasa. Prem. ekhane antoto tai bolte cheyeche), se joto antoh-solila i hok na keno, sudhu tar dum kore newa kichu decisions/ kichu hallucinations ar ek khana lukono kobitay prokash pawa ki jothesto convincing? amar kachhe antoto noy.

Eikhane aboshyo porichalok muchki heshe boltei paren "agei to bole diyechi, Sob choritro Kaalponik". Kaar kolpona? amader? apnar? aapnar kolpona-Ta to amader ThikThak vabe bojhate habe!

To, aapni ki cheyechhilen... kalponik choritro... jara ektu ektu convincing habe, anekkhani noy...ei?
aar, oi ekTu ekTu convincing howar beparta'r abhash to dilo apnader Screenplay, Chokher samne seTa holo koi??


Jeta holo seTa hochche- Somoy noshTo.

---------------------------
(anekdin agey dekhechi film ta Salt Lake City Centre-er Inox e. Sei August e. aj keno eto hejalam ke jane :-))

Tuesday, January 5, 2010

Many happy returns

Happy Birthday. May God bless you now and always.

May you have a good life. One that you may recall as 'good', when you get older.

I miss your writings and those occasional letters.

Wish that you contemplate and write a lot, as much as before.

Hope you've been doing well to this day.

Yours ever,
KS

উত্তরপাড়ার কথা

উত্তরপাড়ার কথা বলি। আমার জন্ম কলকাতায় হলেও, স্কুলবেলার শেষ পর্যন্ত কেটেছে আমার সেখানে। বাড়ি বলতে, পাড়া বলতে, ছোটবেলা বলতে বুঝি- উত্তরপাড়া। হুগলী জেলার এক প্রান্তে থাকা, প্রাচীন এক মফঃসল।

ছোট্ট জায়গা। টাউন বলা যায়। প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। শুধু চেনা নয়, ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানে। লুকিয়ে প্রেম করা দূরে থাক, একা একা ফুচকা বা আইসক্রিম খাওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। যত দূরেই থাকি না কেন, চেনা কেউ একবার দেখতে পেলে হল। ওষুধের দোকানের কাকু, পাশের বাড়ির কাজের মাসি, সদাব্যস্ত মহলানবীশ দাদু- যে দেখতে পাবে চেঁচিয়ে ডাক দিয়ে পিলে চমকে দেবে -কীরে, কবে এলি? আছিস তো এখন? একগাল হেসে বলা-এই তো এলাম, আছি। এটাই আদর। বুকের মধ্যে স্পষ্ট বুঝতে পারা- পৌঁছে গেছি।

অনেকগুলো মাঠ ছিলো। ছোট ছোট। বড় বড়। মাঠের পাশে কল্কেফুলের গাছ,টগরফুলের গাছ, মালতিলতা অনেক ছিল। খেলাধূলায় কোনোদিন-ই তেমন পারদর্শী না হবার ফলে, মাঝে মাঝেই মূল খেলা থেকে বাদ পড়ে যেতাম। দুধভাত। খেললে ভালো, না খেললে আরো ভালো। প্রথমটা অভিমান হত। তারপর সত্যি বলতে ভালোই লাগত কিন্তু। পুরো বিকেলটাই খেলে কাটিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা তখন ছেলেমানুষী মনে হত। এই যে এত ফুল পড়ে আছে মাঠে, দলে পিষে চলে যাচ্ছি খেলতে খেলতে, একটিবারও হাতে তুলে দেখবো না কেমন ফুটেছিল? হাতে ধরত না সব পছন্দের ফুল, জামার পকেটে পুরতাম। সূর্য ডুবে যাবার সময়কার আকাশ দেখতাম ঘুরতে ঘুরতে- কত রঙ ধরত সাদা সাদা মেঘগুলোয়! থাকতো না বেশীক্ষন। নিম গাছ, নারকেল গাছ, কাঠগোলাপ গাছের সারি পেরিয়ে, পুকুর আর রেললাইন পার হয়ে চলে যেত দিনের আলো। বিকেল শেষ হয়ে আসতো। তখনো কলোনি এসোসিয়েশন লাইব্রেরীর মেম্বারশিপ ছিলনা। এমনি রিডিং রুমে গিয়ে অমর চিত্র কথা, নন্টে-ফন্টে, চাচা চৌধুরী পড়ে আবার রেখে আসতাম। বানান করে পড়তে পারি তখন।

দলে দলে ছেলেমেয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত যার যার কোচিং ক্লাসের দিকে। যে বয়েসের কথা বলছি তখন আমার না ছিল সাইকেল, না পারতাম চড়তে। নিজের সম্পত্তি বলতে একটা রঙ করা টিনের বাক্স ছিল, বাবার টেবিলের নিচে রাখতাম। খালি ভাবতাম কবে সাইকেলে চড়ে পড়তে যাব ওই সব দাদা-দিদিদের মত। সাইকেলটাই ছিল আকর্ষণ। খেলে ফেরার পথে, মিষ্টির দোকান থেকে সিঙ্গাড়া ভাজার গন্ধ আসতো। ওসব খাওয়া বারন ছিল অনেকদিন। দেখতাম ফুটবল খেলে ফেরা ধুলোমাখা ছেলেদের, সবাই হাফ প্যান্ট। বগলে বল- উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে হাঁটত। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যেত মিষ্টি বা ঘুগনীর দোকানের সামনে, জল চাইতো। ভাবতাম, ছেলেগুলো কেমন যেন। এত ধুলো মেখে কীকরে এত আনন্দে থাকে কে জানে।
সেইসব ধুলোমাখা ছেলেদের অনেককেই চিনেছি আরেকটু বড় হয়ে, একসঙ্গে পড়তে গিয়ে। ফাংশান বা পিকনিক করতে গিয়ে। কেউ কেউ আমার কিশোরীবেলার বন্ধু।

উত্তরপাড়া গঙ্গার ধারে। বালির দিকে হাঁটতে থাকলে একসময় চোখে পড়বে দক্ষিনেশ্বরের মন্দির, নদীর ওপারে। এপারের রাস্তাটা জি টি রোড। অনেকগুলো ঘাট আছে। নামকরা ঘাটেরা হল- শিবতলার ঘাট, খেয়াঘাট, দোলতলার ঘাট। দোলতলায় বসে দোলের মেলা। দোলের দিন থেকে বসে, দারুণ জমজমাট মেলা। রকমারি নাগরদোলায় চড়া, খেলনা-পুতুল, ভেঁপু-বাঁশি ছাড়াও ছোটদের আকর্ষণ থাকে জিলিপি, বাদামের গুড়-তক্তি, জিবেগজার প্রতি। পাওয়া যায় রসের গজা, নোনতা কাঠিভাজা, নিমকি, ফুটকড়াই, নানারকম আচারও। বড়রাও দেদার খায় এসব, তারসঙ্গে খায় এগরোল, ফিশফ্রাই, চাউমিন। কেনে হাতপাখা, লোহার চাটু, টিফিন কৌটো, চাকি-বেলনা, খুরপি... আরো কত কী। কিনবে বলে টাকা জমিয়ে রাখে রুমালে বেঁধে, সেই পুজোর পর থেকে। পুতুলনাচ হয় একধারে। কাচের চুড়ির দোকানে প্রায় প্রতি বছর আসে নতুন ধরনের কোনো চুড়ি। একবার এসেছিল রামায়ণ চুড়ি, একবার দিলওয়ালে চুড়ি। এখন নাকি আসছে করিনা কাপুর চুড়ি।

দোলের দিন এই দোলতলার ঘাটের চওড়া সিঁড়িগুলো রঙে মাখামাখি হয়ে থাকে আর সন্ধেবেলায় তাদের উপর একটু একটু করে নেমে আসে মোহময়ী জ্যোতস্নারাশি। সোনালী দিনের পরে একটা রূপোলী দিন শুরু হয়। মোহরের মত চাঁদটা গঙ্গার শিয়রে এসে দারুণ এক রোমান্টিক আবহ তৈরী করে দেয়।
খুশি খুশি একটা গন্ধ ছড়িয়ে যেতে থাকে গঙ্গার দিক থেকে আসা ভিজে বাতাসের সঙ্গে। আবির, জিলিপি আর বাদামের ধরা-ধরা শুকনো গন্ধের সঙ্গে মিশে যায়। তার সঙ্গে কখনো সখনো মেশে কামিনী ফুলের গন্ধ। তখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে মনে হয়- এই দুনিয়ার সকল ভালো।

দিনকাল পালটে গেছে অনেক, যেমন যায়। আমাদের বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছটা কাটা পড়েছে, অনেক বছর হয়ে গেল। ওই গাছটায় হাঁকাবুড়ো থাকতো, খুব ভয় পেতাম তাকে।

অনেক মাঠ আর নেই। অনেক বাড়িও। তার বদলে অনেক অনেক নতুন এপার্টমেন্ট তৈরী হয়েছে জায়গা জুড়ে। স্টেশন আর বাজারের দিকটায় সবচেয়ে বেশী। তাদের সবাইকে দেখতে ভালো-ও লাগে না, মানানসই তো নয়-ই। মনে হয় গায়ের জোরে ঢুকে পড়েছে। উত্তরপাড়াকে তার অনেক পুরনো বাসিন্দা এখন ঠাট্টা করে 'ফ্ল্যাটপাড়া' ডাকে।

আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, পারমার স্কুল ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা শান্তিনগর রোড-এ গিয়ে মেশে, সেই মোড়ে একটা বাড়ির গায়ে একটা দোকান ছিল। খুব ছোট, খুব অল্প কটা জিনিস থাকতো। খুব বুড়ো একজন মানুষ চালাতেন দোকানটা। টিউব অথবা বাল্ব কিছুই ছিল না, একটা লন্ঠনের আলোয় কেনা-বেচা চলত রাত্রে। বিড়ি-সিগারেট, দেশলাই, সস্তার চা পাতা থাকত। চানাচুর, ডালমুঠ, ঝাল লজেন্স আর বিস্কুট দেখেছি ম্লানমুখ কতগুলো বয়ামে। পাকানো দড়িতে আগুন জ্বলে থাকতো। খুব ছোটবেলায়, দোকানটা দেখলে আমার কেমন ঘুম-ঘুম পেত। রহস্যময় লাগত বালিকা বয়েসের চোখে। একবার ভেবেছিলাম- বুড়ো মানুষটার কত কষ্ট হয়, ওঁর কি নেই কেউ? হয়ত ছিল, হয়ত কষ্টও হত না তত, তবু কাঁপা-কাঁপা হাতে চা পাতা ওজন করতে দেখে বড্ড মায়া লাগত। আধো অন্ধকারে নিচু চৌকির ওপর চট পেতে বসে থাকা বুড়ো মানুষ। খুব শীতের রাতেও দেখেছি শাল মুড়ি দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। বলাই বাহুল্য, খদ্দের বেশী হতনা।
অনেক বছর ভুলে ছিলাম সেই দোকানটার কথা। মনে পড়ল কয়েকদিন আগে, হঠাত অকারণ। সেই বুড়ো মানুষটা তো নেই-ই, সেই দোকান এমনকি বাড়িটাও নেই।
খুব চেনা, খুব প্রিয় একটা বই থেকে পাতা ছিঁড়ে নেওয়ার মত মনে হয়। আর কটা মাত্র চেনা পাতা বাকি আছে। ওর গল্পগুলোও আর তেমন বুঝতে পারিনা।

(আপাতত শেষ)