বললে বিশ্বাস করা শক্ত, এই বিল্ডিং এর কাউকে চিনিনা আমি। অথচ এখানে আছি অনেকদিন ধরে।
চিনিটা, তেলটা ফুরিয়ে গেলে চাইতে যাওয়া যায় এমন একটাও পড়শী নেই এখানে আমার। এখানে কেন, কোত্থাও নেই।
অথচ আমি জানি কয়েক ধাপ নিচের অ্যাপার্টমেন্টে কাজ চলছে। এত এত ড্রিলিং করে, সারাদিন ধরে ঘষে ঘষে কী তৈরী করছে বা নষ্ট করে ফেলছে জানিনা।তবে হচ্ছে বড়সড় কিছু একটা। সামনের করিডোর বা আশেপাশের সিঁড়িগুলোকে তাই রুগ্ন দেখায়, যেন ক্রনিক অ্যানিমিয়ায় ভুগে ভুগে সাদা হয়ে গেছে।
এখানকার রান্নাঘরের জানালার উল্টোদিকে যাদের জানালা তারা খুবই হিং ও কারিপাতা বিলাসী। মাঝে মাঝে ঘি দিয়ে কিছু রাঁধে, গন্ধে দারুণ খিদে পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি আলো নিভে যায় ওদের রান্নাঘরে। আবার রোজ সকাল সকাল রান্না চাপিয়ে দেয়, কি শীত কি গ্রীষ্ম ছ'টা বাজতে না বাজতেই প্রেশার কুকারে হুইসল পড়তে থাকে। একদিন শুনি রাত বারোটায় হুইসল পড়ছে, অবাক হয়েছিলাম।
এদের ঠিক নিচে যাদের খাবার ঘরের জানালা, তাদের বাড়িতে একটি ছোট্ট মেয়ে থাকে। ময়নাপাখির মতো সারাদিন আধো আধো মারাঠীতে বকর বকর করতে থাকে সে। একদিন লোডশেডিং এর সময় শুনেছিলাম সে তার মাকে জিগ্যেস করছিল মোমবাতিটা (এরা বলে মেমবাত্তি) খালি ছোট হয়ে যাচ্ছে কেন? কে নিয়ে যাচ্ছে? ময়নাপাখির মা সন্ধ্যা হলেই সজোরে হিন্দি সিরিয়াল চালিয়ে দেন আর রাতের দিকে কখনো লোডশেডিং হলে যিনি গান ধরেন তিনি সম্ভবত ময়নাপাখির বাবা। তাঁর গলায় কিশোরকুমার ছাড়া আর কারো গান শুনিনি, নির্ঘাত ফ্যান। মন্দ নয় কিন্তু গলাটা, বেশ সুরে। তবে ওঁর পুঁজি অল্প, তিনটে গান রিপিট হতে থাকে।
একদিন বৃষ্টির সময় দেখি ময়নাপাখিটা জানলা দিয়ে একটা কাপ বাড়িয়েছে বৃষ্টি ধরবে বলে!
এদের নিচের অ্যাপার্টমেন্টে একটি বাঙালী পরিবার থাকে। যেদিন তাঁদের শুঁটকি মাছ রান্না হয় সেদিন সমস্ত জানালা ভালো করে বন্ধ করেও গন্ধের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়না। আজ অব্দি চোখে দেখিনি ঐ পরিবারের কাউকে, টুকটাক বাংলা শব্দ ভেসে আসতে শুনেছি। একদিন গানও শুনেছি- মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি!
বারান্দায় দাঁড়ালে কয়েকটা গাছের আড়ালে যাদের বারান্দা দেখা যায় তাদের রেলিং থেকে লম্বা লম্বা শাড়ি ঝোলে। বারান্দায় শাড়ি ঝুলতে খুব একটা দেখা যায়না আজকাল তাই চোখে পড়েছিল। একদিন বৃষ্টি নামার ঠিক আগে একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি করে তুলছিলো শাড়িগুলো, তার হাতের কাচের চুড়ি ঝিনিক ঝিনিক বাজছিল বেশ।
কাচের চুড়ির মতো রিস্কি জিনিস হাতে পরে এরা নিশ্চিন্তে দিনের এত কাজ কিকরে করে যায় কোনোদিন ভেবে পাইনি।
No comments:
Post a Comment