উত্তরপাড়ার কথা বলি। আমার জন্ম কলকাতায় হলেও, স্কুলবেলার শেষ পর্যন্ত কেটেছে আমার সেখানে। বাড়ি বলতে, পাড়া বলতে, ছোটবেলা বলতে বুঝি- উত্তরপাড়া। হুগলী জেলার এক প্রান্তে থাকা, প্রাচীন এক মফঃসল।
ছোট্ট জায়গা। টাউন বলা যায়। প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। শুধু চেনা নয়, ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানে। লুকিয়ে প্রেম করা দূরে থাক, একা একা ফুচকা বা আইসক্রিম খাওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। যত দূরেই থাকি না কেন, চেনা কেউ একবার দেখতে পেলে হল। ওষুধের দোকানের কাকু, পাশের বাড়ির কাজের মাসি, সদাব্যস্ত মহলানবীশ দাদু- যে দেখতে পাবে চেঁচিয়ে ডাক দিয়ে পিলে চমকে দেবে -কীরে, কবে এলি? আছিস তো এখন? একগাল হেসে বলা-এই তো এলাম, আছি। এটাই আদর। বুকের মধ্যে স্পষ্ট বুঝতে পারা- পৌঁছে গেছি।
অনেকগুলো মাঠ ছিলো। ছোট ছোট। বড় বড়। মাঠের পাশে কল্কেফুলের গাছ,টগরফুলের গাছ, মালতিলতা অনেক ছিল। খেলাধূলায় কোনোদিন-ই তেমন পারদর্শী না হবার ফলে, মাঝে মাঝেই মূল খেলা থেকে বাদ পড়ে যেতাম। দুধভাত। খেললে ভালো, না খেললে আরো ভালো। প্রথমটা অভিমান হত। তারপর সত্যি বলতে ভালোই লাগত কিন্তু। পুরো বিকেলটাই খেলে কাটিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা তখন ছেলেমানুষী মনে হত। এই যে এত ফুল পড়ে আছে মাঠে, দলে পিষে চলে যাচ্ছি খেলতে খেলতে, একটিবারও হাতে তুলে দেখবো না কেমন ফুটেছিল? হাতে ধরত না সব পছন্দের ফুল, জামার পকেটে পুরতাম। সূর্য ডুবে যাবার সময়কার আকাশ দেখতাম ঘুরতে ঘুরতে- কত রঙ ধরত সাদা সাদা মেঘগুলোয়! থাকতো না বেশীক্ষন। নিম গাছ, নারকেল গাছ, কাঠগোলাপ গাছের সারি পেরিয়ে, পুকুর আর রেললাইন পার হয়ে চলে যেত দিনের আলো। বিকেল শেষ হয়ে আসতো। তখনো কলোনি এসোসিয়েশন লাইব্রেরীর মেম্বারশিপ ছিলনা। এমনি রিডিং রুমে গিয়ে অমর চিত্র কথা, নন্টে-ফন্টে, চাচা চৌধুরী পড়ে আবার রেখে আসতাম। বানান করে পড়তে পারি তখন।
দলে দলে ছেলেমেয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত যার যার কোচিং ক্লাসের দিকে। যে বয়েসের কথা বলছি তখন আমার না ছিল সাইকেল, না পারতাম চড়তে। নিজের সম্পত্তি বলতে একটা রঙ করা টিনের বাক্স ছিল, বাবার টেবিলের নিচে রাখতাম। খালি ভাবতাম কবে সাইকেলে চড়ে পড়তে যাব ওই সব দাদা-দিদিদের মত। সাইকেলটাই ছিল আকর্ষণ। খেলে ফেরার পথে, মিষ্টির দোকান থেকে সিঙ্গাড়া ভাজার গন্ধ আসতো। ওসব খাওয়া বারন ছিল অনেকদিন। দেখতাম ফুটবল খেলে ফেরা ধুলোমাখা ছেলেদের, সবাই হাফ প্যান্ট। বগলে বল- উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে হাঁটত। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যেত মিষ্টি বা ঘুগনীর দোকানের সামনে, জল চাইতো। ভাবতাম, ছেলেগুলো কেমন যেন। এত ধুলো মেখে কীকরে এত আনন্দে থাকে কে জানে।
সেইসব ধুলোমাখা ছেলেদের অনেককেই চিনেছি আরেকটু বড় হয়ে, একসঙ্গে পড়তে গিয়ে। ফাংশান বা পিকনিক করতে গিয়ে। কেউ কেউ আমার কিশোরীবেলার বন্ধু।
উত্তরপাড়া গঙ্গার ধারে। বালির দিকে হাঁটতে থাকলে একসময় চোখে পড়বে দক্ষিনেশ্বরের মন্দির, নদীর ওপারে। এপারের রাস্তাটা জি টি রোড। অনেকগুলো ঘাট আছে। নামকরা ঘাটেরা হল- শিবতলার ঘাট, খেয়াঘাট, দোলতলার ঘাট। দোলতলায় বসে দোলের মেলা। দোলের দিন থেকে বসে, দারুণ জমজমাট মেলা। রকমারি নাগরদোলায় চড়া, খেলনা-পুতুল, ভেঁপু-বাঁশি ছাড়াও ছোটদের আকর্ষণ থাকে জিলিপি, বাদামের গুড়-তক্তি, জিবেগজার প্রতি। পাওয়া যায় রসের গজা, নোনতা কাঠিভাজা, নিমকি, ফুটকড়াই, নানারকম আচারও। বড়রাও দেদার খায় এসব, তারসঙ্গে খায় এগরোল, ফিশফ্রাই, চাউমিন। কেনে হাতপাখা, লোহার চাটু, টিফিন কৌটো, চাকি-বেলনা, খুরপি... আরো কত কী। কিনবে বলে টাকা জমিয়ে রাখে রুমালে বেঁধে, সেই পুজোর পর থেকে। পুতুলনাচ হয় একধারে। কাচের চুড়ির দোকানে প্রায় প্রতি বছর আসে নতুন ধরনের কোনো চুড়ি। একবার এসেছিল রামায়ণ চুড়ি, একবার দিলওয়ালে চুড়ি। এখন নাকি আসছে করিনা কাপুর চুড়ি।
দোলের দিন এই দোলতলার ঘাটের চওড়া সিঁড়িগুলো রঙে মাখামাখি হয়ে থাকে আর সন্ধেবেলায় তাদের উপর একটু একটু করে নেমে আসে মোহময়ী জ্যোতস্নারাশি। সোনালী দিনের পরে একটা রূপোলী দিন শুরু হয়। মোহরের মত চাঁদটা গঙ্গার শিয়রে এসে দারুণ এক রোমান্টিক আবহ তৈরী করে দেয়।
খুশি খুশি একটা গন্ধ ছড়িয়ে যেতে থাকে গঙ্গার দিক থেকে আসা ভিজে বাতাসের সঙ্গে। আবির, জিলিপি আর বাদামের ধরা-ধরা শুকনো গন্ধের সঙ্গে মিশে যায়। তার সঙ্গে কখনো সখনো মেশে কামিনী ফুলের গন্ধ। তখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে মনে হয়- এই দুনিয়ার সকল ভালো।
দিনকাল পালটে গেছে অনেক, যেমন যায়। আমাদের বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছটা কাটা পড়েছে, অনেক বছর হয়ে গেল। ওই গাছটায় হাঁকাবুড়ো থাকতো, খুব ভয় পেতাম তাকে।
অনেক মাঠ আর নেই। অনেক বাড়িও। তার বদলে অনেক অনেক নতুন এপার্টমেন্ট তৈরী হয়েছে জায়গা জুড়ে। স্টেশন আর বাজারের দিকটায় সবচেয়ে বেশী। তাদের সবাইকে দেখতে ভালো-ও লাগে না, মানানসই তো নয়-ই। মনে হয় গায়ের জোরে ঢুকে পড়েছে। উত্তরপাড়াকে তার অনেক পুরনো বাসিন্দা এখন ঠাট্টা করে 'ফ্ল্যাটপাড়া' ডাকে।
আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, পারমার স্কুল ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা শান্তিনগর রোড-এ গিয়ে মেশে, সেই মোড়ে একটা বাড়ির গায়ে একটা দোকান ছিল। খুব ছোট, খুব অল্প কটা জিনিস থাকতো। খুব বুড়ো একজন মানুষ চালাতেন দোকানটা। টিউব অথবা বাল্ব কিছুই ছিল না, একটা লন্ঠনের আলোয় কেনা-বেচা চলত রাত্রে। বিড়ি-সিগারেট, দেশলাই, সস্তার চা পাতা থাকত। চানাচুর, ডালমুঠ, ঝাল লজেন্স আর বিস্কুট দেখেছি ম্লানমুখ কতগুলো বয়ামে। পাকানো দড়িতে আগুন জ্বলে থাকতো। খুব ছোটবেলায়, দোকানটা দেখলে আমার কেমন ঘুম-ঘুম পেত। রহস্যময় লাগত বালিকা বয়েসের চোখে। একবার ভেবেছিলাম- বুড়ো মানুষটার কত কষ্ট হয়, ওঁর কি নেই কেউ? হয়ত ছিল, হয়ত কষ্টও হত না তত, তবু কাঁপা-কাঁপা হাতে চা পাতা ওজন করতে দেখে বড্ড মায়া লাগত। আধো অন্ধকারে নিচু চৌকির ওপর চট পেতে বসে থাকা বুড়ো মানুষ। খুব শীতের রাতেও দেখেছি শাল মুড়ি দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। বলাই বাহুল্য, খদ্দের বেশী হতনা।
অনেক বছর ভুলে ছিলাম সেই দোকানটার কথা। মনে পড়ল কয়েকদিন আগে, হঠাত অকারণ। সেই বুড়ো মানুষটা তো নেই-ই, সেই দোকান এমনকি বাড়িটাও নেই।
খুব চেনা, খুব প্রিয় একটা বই থেকে পাতা ছিঁড়ে নেওয়ার মত মনে হয়। আর কটা মাত্র চেনা পাতা বাকি আছে। ওর গল্পগুলোও আর তেমন বুঝতে পারিনা।
(আপাতত শেষ)
1 comment:
দিদি খুব ভাল লিখেছেন। সেই ছোট্টবেলা, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
Post a Comment