Wednesday, September 22, 2010

যাও মেঘ

বর্ষাকালে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটা সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। ঘুটঘুটে ঘন জঙ্গলগুলোয় তো বটেই, পুরোনো পাথুরে বিল্ডিং-এর গা বেয়ে ওঠা ঝাঁকড়া লতা আর পাথরের জোড় বরাবর গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার মখমলি স্তরেও উপচে পড়তে থাকে সবুজ। সবুজ মানে কাঁচা, সবুজ মানে উল্লাস! সবুজ মানে একরত্তির মধ্যে বাঁধা পড়েছে আলো। মনে হয় সবকিছুর মধ্যে এতো এতো প্রাণ আছে!

পাঁচিলের ইঁট, বিল্ডিঙের পাথর, মোটা মোটা কাঠ, কড়িবরগা - সকলেই শ্বাস নেয় তখন। চাইলে ফিক করে হেসে ফেলতে পারে, পড়া বলতে পারে, বলে দিতে পারে কোন রাস্তা ধরে গেলে তুমি ঠিক ঠিক মেইন বিল্ডিং বা জয়কর লাইব্রেরী পৌঁছে যেতে পারো।

মেইন গেট দিয়ে ঢোকার পর বেশ গোলমেলে ঠেকে ভিতরটা। কোন দিকে যাবে? বড্ড বড় ক্যাম্পাস, কোন পথ কোথায় যায় জানতে হলে ম্যাপ দেখে নিতে হয়। এলোমেলো ভুল দিকে চলে গেলে খুব মুস্কিল; ভালো হাঁটতে না পারলে, দিনের দিন পায়ে হেঁটে ঠিক জায়গায় না-ও পৌঁছতে পারো। সেটা বেশ অসুবিধের, আবার হাতে তেমন কোনো কাজ না থাকলে, সেটা দারুণ মজার। মনে হয় জঙ্গলে বেরিয়েছি বেশ, অ্যাডভেঞ্চারে। মনে হয়, বাঘ না হোক, হরিণ-টরিণ পেয়ে যাব।

হাঁটো, হাঁটো। কতো গাছের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। সরু সরু রাস্তা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। জঙ্গুলে পাকদণ্ডীও আছে, তাদের সুলুক-সন্ধান জানা থাকলে সেদিকে যাওয়া যায়, জোঁকের কামড় খাওয়া যায়। মেডুসার চুলের মতো বুড়ো বটের ঝুরি নেমে আসবে তোমায় ঘিরে, ছুঁয়ে ফেলবে গাল। মিঠে রোদে পড়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন গাছের গা বেয়ে উঠেছে পানপাতার মতো পাতাওলা এক বল্লরী। দেখবে তার পোশাক থেকে কোঁচকানো চুলের মতো অসংখ্য সবজেটে সুতো নেমে এসেছে। গাছেদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা তুলেছে আশপাশের সকলকে ছাড়িয়ে। চিরউন্নত বিদ্রোহী শির। বিদ্রোহীদের মধ্যে দেখা হয়ে গেলে তারা কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঝিরিঝিরি চাঁদোয়া তৈরী করে ফেলে। এভাবে কোথাও কোথাও বন্দী হয়ে থাকে আকাশ। এই ঘন পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসে হিরের আংটির দ্যুতির মতো।

বটের গুঁড়িতে ঘন সবুজের আস্তরণ, পায়ের কাছে কাদা হয়ে আছে মাটি। সাদা সাদা রসালো ব্যাঙের ছাতা উঠেছে তার পাশে, ইতস্তত বসে আছে খেলনাবাটি সাজিয়ে। ছাতার গায়ে পুটিপুটি দাগ। ঘুঙুরের শব্দ পেলে? পাশেই তো সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট। ললিত কলা কেন্দ্র। নাচ শেখা চলছে ওই দিকটায়। হাতে তালি দিয়ে দিয়ে বোল বলছেন কেউ, তার সঙ্গতে ঝমঝম বাজছে ঘুঙুর, বাজছে চঞ্চল পায়ের পাতা। সেই ছন্দময় শব্দ মৃদু এক গুঞ্জনের মতো ভেসে আসতে থাকে। মিশে যেতে থাকে পাতা কাঁপিয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, পাখি আর পোকার শব্দ, ভ্রমরের শব্দের সাথে।

মস্ত বড় পুকুর আছে, অযত্নলালিত। পুকুরে পাতা ভাসে, পদ্ম ফোটে, হাঁস চরে। পুকুরের কাছেই আছে বড়সড় একটা পার্ক। এখানে বসে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে একটা বেলার পাতা নিশ্চিন্তে উলটে দেওয়া যায়। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বত্থ, বট, গুলমোহর। আছে অমলতাস, নিম, কাঠগোলাপ, শিউলি। মাঝবর্ষা থেকেই শিউলির ফুল ফোটানো শুরু হয়ে যায়। বেঞ্চিতে বসে বসে অনেক পাখির ডাক শোনা যায়। চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেউ কেউ, খাবার খুঁজে বেড়ায়। কেউ কেউ শুধু অলস বসে থাকে, উঁচুমতো একটা ডাল বেছে নিয়ে শিস দিয়ে বেলা কাটায়।

শহরের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী কম থাকে ক্যাম্পাসের তাপমাত্রা। ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে থাকে। শীতকালের দুপুরবেলায় গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে শিরশির করে গা, সোয়েটার পরা থাকলেও। স্কার্ফ রাখতে হয় সঙ্গে। বিকেলের পর থেকে হিম পড়ে একটু একটু করে। শীতের দিনে বদলে যায় ক্যাম্পাসের রঙ। বর্ষাকালের মতো রাজকীয় বিন্যাস আর থাকেনা তার। পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোকে বড় বিষণ্ণ দেখায়। শুকনো, স্থবির। ভালো লাগে না। তাই শীতকালে পারতপক্ষে এদিকে বেড়াতে নিয়ে আসি না কাউকে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি পেরিয়ে এলাম, অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট। আজকের মধ্যে পুরোটা দেখা সম্ভব না। মেইন বিল্ডিঙের পরে আরো অনেকখানি আছে। অনেকগুলো মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্কুল, হস্টেল, জঙ্গল। তারও পরে আছে বেশ কিছু অফিস, ওপাশে কয়েকটা রিসার্চ ইন্সটিট্যুট, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, জলের ট্যাঙ্ক, মাঠ, জঙ্গল। সে অনেক দূর। কোথায় যাবে এবার? চা খাবে? ক্যান্টিন চাই? ওই তো। এখান থেকে একটুখানি। অবেলায় পেট ভরে খেতে চাইলে ছাদওয়ালা ক্যান্টিনটায় যাও। পাব্লিকেশন ডিপার্টমেন্টের পাশে। খুব পুরোনো সব বাড়ি। অচেনা এক বুনো ঝোপের গন্ধ আসে। ঘুম ঘুম ঠাণ্ডা কালচে পাথর আর ভিজেমাটি মেশানো গন্ধ। বাঁশের কঞ্চি কেটে চাটাইয়ের মতো ক্রিসক্রস বুনে ঘিরে রাখা আছে নিচু টানা-বারান্দাগুলো। কতোকালের চিহ্ন লেগে আছে এদের গায়ে। কাছে গেলে মনে হতে থাকে সেইসব কালে যেন পা পড়ে গেলো।

কুপন কেটে চা আর খাবার নিতে হয়। এখানকার খাবার বেশ সস্তা। সাবসিডাইজড রেট কিনা কে জানে। আয়েস করে খাও। দেখতে দেখতে মেঘ ক’রে বৃষ্টি নামলো। এখন বেরোনোর উপায় নেই। বরং ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসো, যার উল্টোদিকের টেবিল ঘিরে পার্ট-টু’র ছেলেমেয়েরা থিয়েটারের গল্প করছে। একটু পরে ওদের রিহার্সাল শুরু হওয়ার কথা, ধুম বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেছে। কাঠের টেবিল, প্লাস্টিকের চেয়ার, রঙচটা ডিশ। আবার হয়তো অনেকদিন পর এদেরকে মন দিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।

বৃষ্টিতে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে সামনের রাস্তাটা। ওই রাস্তাটাই শাখানদীর মতো ভেঙে ভেঙে চলে গেছে এদিক সেদিক। যেতে যেতে হরেক দূরকে এনে দিয়েছে এতোখানি কাছে, আবার সময় ফুরোলে নিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর।


---

(পুণা ইউনিভার্সিটির কথা)

2 comments:

Unknown said...

chokher shamne phutea tulechis kotha dea. mushroomer orokom description hote pare amar jana chilo na.jao megh lekhata khubi shundor hoeche. ekdom tor lekha sobujer moton.bhalo hoea gelo monta pore.

Shuchismita said...

Mumbai campus er katha mone poRchhe khub. Jodio Puna mone hoy taar cheyeo sundor. prithibir sreshTho brishTi je bharoter poshchim prantei hoy ta niye amar kono sondeho nei. adbhut bhalo likhechhis. ami dekhte pachchhi... tumul brishTi-te aaTke gechhi... kaTher bench e cholchhe adda... samne baRa pao aar dhNoya oTha cha..