Monday, September 27, 2010

কৌন কহে কব আওয়ে প্রীতম

আজ সকাল সকাল ইমনকে মনে পড়লো। সন্ধ্যার পবিত্রতম কিছু রঙ বুকে নিয়ে যে অস্তরাগরঞ্জিতা অপেক্ষা করে থাকে সূর্য ডুবে যাওয়ার, চন্দনগন্ধি সেই কিশোরীর নাম ইমন। ওর জন্য একটি তার পঞ্চমে, আরেকটি নিষাদে রেখে বাঁধা হয় তানপুরো। জোয়ারী করে তোলা হয় সাঁঝের গাঙ, যার ওপর সে অনায়াসে ভাসাতে পারে তার পালকের মতো ফুরফুরে, মুক্তোর মতো নিটোল আসমানী ময়ূরপঙ্খী।

সন্ধ্যা নেমে আসে। পুব-আকাশে মেঘ সরে যায়, হঠাত করে একফালি চাঁদ দেখতে পেয়ে খুশী হয় কিশোরী। দুচোখে তার কড়ি মধ্যমের বিস্ময় ফুটে ওঠে। ময়ূরপঙ্খীর খোলা ছাদে জাফরি কাটা আলসের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে। আর কতো দেরী? কখন আসবে তার প্রীতম? আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে যে! তবে কি আজ দেরী হবে? হাওয়ায় উড়তে থাকে তার রেশমের মতো সুরেলা আঁচল। জ্যোতস্নায় ধুয়ে যায় তার গা। মনে মনে একান্তভাবে গান্ধারকে ডাকে সে। এসো গহীন, এসো।

অরণ্যের মধ্যে, স্ফটিকের আসনে বসে মালায় প্রহর গাঁথে হেমবরণ, পলাশলোচন শুদ্ধ গান্ধার। অনন্ত প্রেমরসে বিভোর হয়ে থাকে মধ্যরাতের মতো গহীন সেই পুরুষ। গন্ধর্বলোকে তার কাছে পৌঁছয় ইমনের ডাক।
একসময় কিশোরীর বন্ধ চোখের ওপর ভাসতে থাকে শুদ্ধ গান্ধারের ছায়া। ইমনের কাঁপতে থাকা অধরে সে বীণকারের অমোঘ আঙুল রাখে।

ইমনসকাশে গান্ধারকে যেমন করে দেখতে পাওয়া যায়, এমন আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই তীব্র সকালে কেন মনে পড়লো আজ তাদের কথা? আমার রৌদ্রস্নাত, তরতরে ঝরঝরে সকালগুলোও কি আসলে নিবিড় কোনো সন্ধ্যার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে?
হয়তো তাই। এক মায়া-অন্ধকারে মিশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আমাদের অবচেতন। অজান্তে সাধনা করে সেই সময়ের জন্য, যখন কিশোরী ইমনকে বিস্তৃতি দেবে নিষাদ ছুঁয়ে রেখাবের সুর লাগানো গান্ধার আর গান্ধারকে পরম যত্নে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেবে কমলকলির মতো ফুটে উঠতে থাকা ইমন।

Wednesday, September 22, 2010

যাও মেঘ

বর্ষাকালে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটা সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। ঘুটঘুটে ঘন জঙ্গলগুলোয় তো বটেই, পুরোনো পাথুরে বিল্ডিং-এর গা বেয়ে ওঠা ঝাঁকড়া লতা আর পাথরের জোড় বরাবর গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার মখমলি স্তরেও উপচে পড়তে থাকে সবুজ। সবুজ মানে কাঁচা, সবুজ মানে উল্লাস! সবুজ মানে একরত্তির মধ্যে বাঁধা পড়েছে আলো। মনে হয় সবকিছুর মধ্যে এতো এতো প্রাণ আছে!

পাঁচিলের ইঁট, বিল্ডিঙের পাথর, মোটা মোটা কাঠ, কড়িবরগা - সকলেই শ্বাস নেয় তখন। চাইলে ফিক করে হেসে ফেলতে পারে, পড়া বলতে পারে, বলে দিতে পারে কোন রাস্তা ধরে গেলে তুমি ঠিক ঠিক মেইন বিল্ডিং বা জয়কর লাইব্রেরী পৌঁছে যেতে পারো।

মেইন গেট দিয়ে ঢোকার পর বেশ গোলমেলে ঠেকে ভিতরটা। কোন দিকে যাবে? বড্ড বড় ক্যাম্পাস, কোন পথ কোথায় যায় জানতে হলে ম্যাপ দেখে নিতে হয়। এলোমেলো ভুল দিকে চলে গেলে খুব মুস্কিল; ভালো হাঁটতে না পারলে, দিনের দিন পায়ে হেঁটে ঠিক জায়গায় না-ও পৌঁছতে পারো। সেটা বেশ অসুবিধের, আবার হাতে তেমন কোনো কাজ না থাকলে, সেটা দারুণ মজার। মনে হয় জঙ্গলে বেরিয়েছি বেশ, অ্যাডভেঞ্চারে। মনে হয়, বাঘ না হোক, হরিণ-টরিণ পেয়ে যাব।

হাঁটো, হাঁটো। কতো গাছের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। সরু সরু রাস্তা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। জঙ্গুলে পাকদণ্ডীও আছে, তাদের সুলুক-সন্ধান জানা থাকলে সেদিকে যাওয়া যায়, জোঁকের কামড় খাওয়া যায়। মেডুসার চুলের মতো বুড়ো বটের ঝুরি নেমে আসবে তোমায় ঘিরে, ছুঁয়ে ফেলবে গাল। মিঠে রোদে পড়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন গাছের গা বেয়ে উঠেছে পানপাতার মতো পাতাওলা এক বল্লরী। দেখবে তার পোশাক থেকে কোঁচকানো চুলের মতো অসংখ্য সবজেটে সুতো নেমে এসেছে। গাছেদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা তুলেছে আশপাশের সকলকে ছাড়িয়ে। চিরউন্নত বিদ্রোহী শির। বিদ্রোহীদের মধ্যে দেখা হয়ে গেলে তারা কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঝিরিঝিরি চাঁদোয়া তৈরী করে ফেলে। এভাবে কোথাও কোথাও বন্দী হয়ে থাকে আকাশ। এই ঘন পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসে হিরের আংটির দ্যুতির মতো।

বটের গুঁড়িতে ঘন সবুজের আস্তরণ, পায়ের কাছে কাদা হয়ে আছে মাটি। সাদা সাদা রসালো ব্যাঙের ছাতা উঠেছে তার পাশে, ইতস্তত বসে আছে খেলনাবাটি সাজিয়ে। ছাতার গায়ে পুটিপুটি দাগ। ঘুঙুরের শব্দ পেলে? পাশেই তো সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট। ললিত কলা কেন্দ্র। নাচ শেখা চলছে ওই দিকটায়। হাতে তালি দিয়ে দিয়ে বোল বলছেন কেউ, তার সঙ্গতে ঝমঝম বাজছে ঘুঙুর, বাজছে চঞ্চল পায়ের পাতা। সেই ছন্দময় শব্দ মৃদু এক গুঞ্জনের মতো ভেসে আসতে থাকে। মিশে যেতে থাকে পাতা কাঁপিয়ে যাওয়া হাওয়ার শব্দ, পাখি আর পোকার শব্দ, ভ্রমরের শব্দের সাথে।

মস্ত বড় পুকুর আছে, অযত্নলালিত। পুকুরে পাতা ভাসে, পদ্ম ফোটে, হাঁস চরে। পুকুরের কাছেই আছে বড়সড় একটা পার্ক। এখানে বসে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে একটা বেলার পাতা নিশ্চিন্তে উলটে দেওয়া যায়। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বত্থ, বট, গুলমোহর। আছে অমলতাস, নিম, কাঠগোলাপ, শিউলি। মাঝবর্ষা থেকেই শিউলির ফুল ফোটানো শুরু হয়ে যায়। বেঞ্চিতে বসে বসে অনেক পাখির ডাক শোনা যায়। চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেউ কেউ, খাবার খুঁজে বেড়ায়। কেউ কেউ শুধু অলস বসে থাকে, উঁচুমতো একটা ডাল বেছে নিয়ে শিস দিয়ে বেলা কাটায়।

শহরের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী কম থাকে ক্যাম্পাসের তাপমাত্রা। ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে থাকে। শীতকালের দুপুরবেলায় গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে শিরশির করে গা, সোয়েটার পরা থাকলেও। স্কার্ফ রাখতে হয় সঙ্গে। বিকেলের পর থেকে হিম পড়ে একটু একটু করে। শীতের দিনে বদলে যায় ক্যাম্পাসের রঙ। বর্ষাকালের মতো রাজকীয় বিন্যাস আর থাকেনা তার। পাতা ঝরে যাওয়া গাছগুলোকে বড় বিষণ্ণ দেখায়। শুকনো, স্থবির। ভালো লাগে না। তাই শীতকালে পারতপক্ষে এদিকে বেড়াতে নিয়ে আসি না কাউকে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি পেরিয়ে এলাম, অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট। আজকের মধ্যে পুরোটা দেখা সম্ভব না। মেইন বিল্ডিঙের পরে আরো অনেকখানি আছে। অনেকগুলো মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্কুল, হস্টেল, জঙ্গল। তারও পরে আছে বেশ কিছু অফিস, ওপাশে কয়েকটা রিসার্চ ইন্সটিট্যুট, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, জলের ট্যাঙ্ক, মাঠ, জঙ্গল। সে অনেক দূর। কোথায় যাবে এবার? চা খাবে? ক্যান্টিন চাই? ওই তো। এখান থেকে একটুখানি। অবেলায় পেট ভরে খেতে চাইলে ছাদওয়ালা ক্যান্টিনটায় যাও। পাব্লিকেশন ডিপার্টমেন্টের পাশে। খুব পুরোনো সব বাড়ি। অচেনা এক বুনো ঝোপের গন্ধ আসে। ঘুম ঘুম ঠাণ্ডা কালচে পাথর আর ভিজেমাটি মেশানো গন্ধ। বাঁশের কঞ্চি কেটে চাটাইয়ের মতো ক্রিসক্রস বুনে ঘিরে রাখা আছে নিচু টানা-বারান্দাগুলো। কতোকালের চিহ্ন লেগে আছে এদের গায়ে। কাছে গেলে মনে হতে থাকে সেইসব কালে যেন পা পড়ে গেলো।

কুপন কেটে চা আর খাবার নিতে হয়। এখানকার খাবার বেশ সস্তা। সাবসিডাইজড রেট কিনা কে জানে। আয়েস করে খাও। দেখতে দেখতে মেঘ ক’রে বৃষ্টি নামলো। এখন বেরোনোর উপায় নেই। বরং ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসো, যার উল্টোদিকের টেবিল ঘিরে পার্ট-টু’র ছেলেমেয়েরা থিয়েটারের গল্প করছে। একটু পরে ওদের রিহার্সাল শুরু হওয়ার কথা, ধুম বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেছে। কাঠের টেবিল, প্লাস্টিকের চেয়ার, রঙচটা ডিশ। আবার হয়তো অনেকদিন পর এদেরকে মন দিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।

বৃষ্টিতে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে সামনের রাস্তাটা। ওই রাস্তাটাই শাখানদীর মতো ভেঙে ভেঙে চলে গেছে এদিক সেদিক। যেতে যেতে হরেক দূরকে এনে দিয়েছে এতোখানি কাছে, আবার সময় ফুরোলে নিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর।


---

(পুণা ইউনিভার্সিটির কথা)

Tuesday, September 14, 2010

পুষ্পা

প্রচণ্ড বাজে বকতো মেয়েটা। রুমে থাকলে বকে বকে আমার মাথা খেতো। দুর্বোধ্য সব কারণে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়তো আমার বিছানায়। আমি দেখতাম ওর ছোট ছোট কালো চুলে বেগুনী ক্লিপ, ফর্সা গালে ব্লাশ-অন। বড় বড় শেপ করা নখে লাল নেলপলিশ লাগানো। ঠোটে একই রঙের ম্যেবেলিন-রঞ্জনী, গাঢ় করে লেপা। এত বেশী লাল ভাল্লাগতো না আমার। বাড়াবাড়ি। প্রায়ই তাড়াতাম ওকে ঘর থেকে। পুষ্পা তুম যাও অভি, প্লিজ যাও। কী ভাগ্যি ও বেশীক্ষণ হস্টেলে থাকতো না।



কোনো দরকারে ওর সঙ্গে বেরোনোটা ছিল ভয়ানক মুস্কিলের ব্যাপার। নানারকম ছাপছোপ মারা মিনি স্কার্ট পরে হেলেদুলে হাঁটবে পুষ্পা। ঝকমকে বুটস পরবে। কটকটে লাল টপের ওপর তালিমারা ম্রিয়মাণ ডেনিম জ্যাকেটের চেন যদি বা বন্ধ রাখবে, মুখ বন্ধ রাখার কোনো গল্প ছিলোনা ওর। অদ্ভুত সব বোকা বোকা কথা চেঁচিয়ে বলতে বলতে, জোরে জোরে হাসতে হাসতে যেতো সারাটা রাস্তা, উত্তর না দিলে একাই বকে যেত। কী আপদ! খুব স্বাভাবিকভাবেই পথচলতি মানুষের নজর যেতো ওর দিকে। ভেসে আসতো উড়ো কমেন্ট, যার সবকটাকে খুব শ্লীল বলা চলে না। কমেন্ট এসে আবার মাটিতে পড়তে পেতো না, কানে গেলেই ক্ষেপে উঠতো পুষ্পা, শানানো উত্তর দেওয়া শুরু করে দিতো। কী দরকার তোর উত্তর দেবার? হোপলেস। এতো অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ার করিস কেনো তুই?



ও বুঝতে চাইতো না। পিত্তি জ্বলে যেতো আমার। এরকম দু-একটা অভিজ্ঞতা হওয়ার পর ভুলেও বেরোতাম না ওর সঙ্গে। ও কাকুতি-মিনতি করলেও কড়াভাবে নাবলে দিতাম। মনে মনে ততদিনে ওকে দাগিয়ে দিয়েছিলাম বখে যাওয়া মেয়েহিসেবে। পুষ্পা ছিল মণিপুরী। হিস্ট্রি নিয়ে বি এ পড়তো নৌরোসজী ওয়াড়িয়া কলেজে। কলেজটা নামকরা। কীভাবে চান্স পেয়েছিলো, এনরোল্মেন্ট-টাই বা কেমনকরে টিকিয়ে রেখেছিল জানা নেই আমার। পড়াশোনা অল্প-স্বল্প করতো ঠিকই, কলেজ যেতে খুব একটা দেখতামনা ওকে



সকাল হতে না হতেই ওর দড়িবাঁধা (নইলে স্পিকারের সামনেটা খুলে আসতো) স্টিরিওটায় মারাত্মক সব ভজন চালাতো পুষ্পা। গোবিন্দ বোলো হরি, গোপাল বোলো!! গোপালা গোপালা রে, পেয়ারে নন্দলালা। তবে রে! আশেপাশের রুম থেকে ছুটে আসতো মেয়েরা। কেউ একজন ওর প্লেয়ারের সুইচে থাবড়া মেরে বলতো “এ বন্দ কর তেরা ইয়ে রোজ রোজ কা নাটক! সোনে দে।” পাগলের মতো ঝগড়া শুরু করতো পুষ্পা তখন। কিছুতেই ওর ভজন বন্ধ করবে না। বাধ্য হয়ে কম্বল ছেড়ে উঠতাম আমি, চেঁচাতাম। “পুষ্পা! কী হচ্ছে কী সকাল সকাল, বন্ধ না করিস, আওয়াজটা কম কর। কানে লাগছে তো সবার!” কেন জানিনা একটু হলেও আমার কথা শুনতো এই অবাধ্য, ঝগড়ুটে মেয়েটা। মেয়েরা গজগজ করতে করতে চলে যাবার পর আমার দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞভাবে বলতো, সুবহা সুবহা ভগোয়ান কা নাম লেনা চাহিয়ে না? ইয়ে লোগ নেহী সমঝতে হেয়! “নহী সমঝতে” র লিস্ট থেকে আমাকে কেন বাদ দিতো ওই জানে।



অপার ভক্তি ছিল পুষ্পার। সোমবার শিবের উপোস। বৃহস্পতিবার গনেশজীর। লেগেই থাকতো। দরজায় নক করে প্রায়ই পেঁড়া দিতে আসতো আমাকে। মুখে হাসি। “সবকো নাহি দেঙ্গে হম। সির্ফ তুমহে, সারিকাদিদিকো ঔর লক্ষ্মীদিদিকো দেনা হেয়। বাকি সারে লড়কিয়াঁ মুঝে খারাব বোলতে হেয়। সব সালে সুয়ার কে ঔলাদ”। আঃ, পুষ্পা! ওকে থামাতাম আমি। এতো গালি দিস কেনো তুই? মন্দিরে পুজো দিয়ে এলি কিসের জন্য? কী লাভ হচ্ছে তোর? উল্টোপাল্টা কথা বলা ছাড়বি না, ঐরকম সাজবি তো খারাপ-ই বলবে সবাই। বেশ করবে। হিম্মত থাকে তো শোন। গালি দিচ্ছিস কেন? রেগে যেতো পুষ্পা। পেঁড়াটা ধরিয়ে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করতো, তুমি কী জানো! আমার জাত নিয়ে, ইজ্জত নিয়ে কথা বলে ওরা। ‘চিঙ্কি’ বলে আমাকে, ফ্যামিলি তুলে জোক মারে তা জানো। আমি নাকি খারাপ মেয়ে। কী জানে ওরা? কী জানে? আমার বাবা আর্মিতে, দাদু আর্মিতে ছিলো। আমরা বৈষ্ণব, তা জানো? আমাদের বাড়ির কালচারই আলাদা। আমি কথা বলতে ভালোবাসি, সাজতে ভালোবাসি তাই...” ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করে দিতো। হাইপার মেয়ে ছিলো পুষ্পা। খুব একটা সুস্থও ছিলোনা।



“যা ঘরে যা, কেউ শুনতে পাবে, আর ঝগড়া বাধাস না”। ও চোখ তুলে তাকাতো হঠাত “মুঝে আলা কি ইয়াদ আতি হেয় তো ম্যায় মন্দির চলি যাতি হুঁ। মেরা আলা কিঁউ ছোড়কে গয়া মুঝে!” উফফ, আবার সেই এক কথা!



এই আলা নামের রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি, আল্লাহ-কে আলা বলতো কিনা জানিনা। এই নামে পুষ্পার একটি বয়ফ্রেণ্ড ছিলো। শুনেছি সে প্যালেস্টাইনের ছেলে, পুণার সিম্বায়োসিস ইন্সটিট্যুটে পড়তে এসেছিলো। তার সঙ্গে নাকি পুষ্পার আলাপ হয়েছিল পুনের এম জি রোডে কোথাও, এবং আলাপ হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই আলার সঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনশিপে যেতে কোনো আপত্তি ছিলোনা পুষ্পার। এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে ওয়াড়িয়া কলেজের আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট গার্লস-হস্টেল ছাড়তে হয়েছিলো, পার্ট টাইম কাজ নিতে হয়েছিল একটা কসমেটিক শপে। বাড়িতে কী বলেছিলো কে জানে! আলা যে ভিনদেশী মুসলিম ছিলো, তা নিয়েও কোনো মাথাব্যথা ছিলোনা গোঁড়া হিন্দু পুষ্পার, অন্তত আমি দেখিনি। ভালো করে চেনা নেই শোনা নেই একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে কেনো থাকতে চলে গেছিলো জিজ্ঞেস করলে সহজ উত্তর পাওয়া যেতো, উসসে বহোত পেয়ার করতি থি ম্যায়। বোঝো।



শুনেছি নিজের কোর্স শেষ হয়ে যাবার পর চাকরী নিয়ে দুবাই চলে গেছিলো আলা। পুষ্পাকে নিকাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছিলো যাবার আগে। সে নাকি বলেছিলো, বছরদুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে পুষ্পাকে বিয়ে করে নিজের দেশ প্যালেস্টাইনে নিয়ে যাবে। আলা চলে যাবার পর প্রথম দু-এক মাস ফোনে আর ইন্টারনেট-চ্যাটে কথা হতো তাদের। ধীরে ধীরে কমতে কমতে একদিন সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। ফোন নাম্বার পালটে নিয়েছিলো আলা। কোনো ই-মেলের জবাব আসতো না আর। পুষ্পা বিশ্বাস করতে পারতো না আলা তাকে ঠকিয়েছে, স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছে তাকে। ও কেবল ভাবতো আলার হয়তো কোনো বিপদ হয়েছে। পাগলের মতো যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যেতো ও, আলার বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ করতো। এভাবে খোঁজ করতে করতে একদিন রাত্রে কারোর কাছে পুষ্পা খবর পেলো, আলা নাকি আসলে বম্বেতে আছে, বোরিভলীর কাছে কোথাও দেখা গেছে তাকে। অপরিণামদর্শী, বেপরোয়া পুষ্পা সেই রাত্রেই বেরিয়ে পড়েছিলো আলার এক পুরোনো ক্লাসমেট হায়দারের সাথে, বাইকে। সদ্য নির্মিত মুম্বই-পুনে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে তীব্রগতিতে যেতে যেতে বাইকটি এক্সিডেন্ট করে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় হায়দার, মারাত্মক জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় পুষ্পা।



একটি হাত, একটি পা আর জ’বোন বা ম্যাণ্ডিবল টুকরো হয়ে গেছিল পুষ্পার, মাথায় গুরুতর আঘাত ছিলো। চারবার সার্জারি ও আড়াই মাস হাসপাতালে থাকার পর মণিপুরের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুষ্পাকে। এর প্রায় বছরখানেক পর, পুণায় ফিরে গিয়ে কলেজের পড়াশোনা চালু করার জন্য বাবা-মায়ের কাছে বারবার অনুরোধ করতে থাকে সে। সকলের অমতেই এই দ্বিতীয়বার পড়তে আসা তার। এসব ঘটনা ওর মুখেই শুনেছিলাম। অজস্র সেলাইয়ের দাগ দেখেছিলাম ওর মাথায়, হাতে, পায়ে। মেসের খাবার খেতে পারতো না ও, রান্না করে খেতো। রুমের এক কোণায় স্টোভ জ্বালিয়ে রাঁধতো। এমনিতে রুমে কোনোরকম আগুন জ্বালানোর অনুমতি ছিলোনা, শুধুমাত্র ওর অবস্থা বিবেচনা করে ওকে স্পেশাল পার্মিশন দিয়েছিলো হোস্টেল অথরিটি। ওর রুমের সামনে দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার দেখেছি, এক হাতে নোটস, অন্য হাতে খুন্তি নিয়ে জোরে জোরে পড়তে পড়তে পায়চারি করছে পুষ্পা। একপাশে কড়াইতে ঝোল বা খিচুড়ি টাইপের কিছু ফুটছে।



হস্টেলে থাকার সময় একবার ভাইরাল ফিভার হয়েছিলো আমার। হঠাত করেই অনেকটা জ্বর উঠে গেছিলো। এই অর্ধ-উন্মাদ মেয়েটা লক্ষ্মীদিদির কথামতো সারারাত জেগে বসেছিল আমার বিছানার পাশে। জলপটি দিয়েছিল, প্রেস্ক্রিপশন আনুযায়ী ওষুধ এনে খাইয়েছিলো হাতে করে। কদিন ওর স্টোভেই রান্না হয়েছিল আমার পথ্য। অনেক বাধা দেওয়া সত্বেও জোর করে বেশ কয়েকবার কেচে দিয়েছিল আমার জামাকাপড়। প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীদিদি পেশায় ডাক্তার ছিলো, সসুন হাসপাতালে এম ডি করছিলো তখন। লক্ষ্মীদিদিও কল্পনাতীত যত্ন নিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলো আমায়। বাইরের কোনো ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অসুখের সময় পুষ্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “কেনো এতো যত্ন করছিস বলতো? আমিতো শুধুই বকাবকি করি তোকে”। জ্ঞানপাপীর মতো উত্তর দিয়েছিলো “ম্যায় কাম হি এয়সা করতি হুঁ না, ইসলিয়ে ডাঁটতি হো। কেয়ার করতি হো, তভি না ডাঁটতি হো”। সত্যিই হোপলেস কেস।



হোস্টেল ছেড়ে চলে আসার আগে পুষ্পা আমার ঠিকানা লেখার ডায়রী চেয়ে নিয়ে তাতে যত্ন করে ওর সমস্ত পার্থিব ঠিকানা লিখে দিয়েছিলো। বলেছিলো, চিঠি দিও, এসো আমার মণিপুরের বাড়িতে। চিঠি দেওয়া হয়নি আমার, আর কখনো দেখাও হয়নি ওর সাথে। আমি জানি ওর সঙ্গে আমার ঠিক বন্ধুত্ব ছিলোনা। কোনোদিন ঠিক ভালোবাসিনি ওকে। উলটে কোনো কোনো সময় ওকে দারুণ অপছন্দ করেছি, এড়িয়ে চলেছি। তবু আজ ওর কথা লিখছি কারণ এমন অদ্ভুত নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে খুব কম মানুষকে দেখেছি।



পুষ্পা সুন্দরী ছিলো। বেশ সুর ছিলো গলায়। যেদিন ওকে রুম থেকে চটপট তাড়িয়ে না দিতাম, হেসে হেসে দুলে দুলে গান গেয়ে শোনাতো- অজীব দাস্তাঁ হেয় ইয়ে, কাহাঁ শুরু কাহাঁ খতম। ওর আলা নাকি ওর গলায় এই গানটা শুনতে চাইতো। সে নাকি চাইতো ও সবসময় সাজগোজ করে থাকুক তাই পুষ্পার জন্মদিনে ওকে খুব দামী একটা মেক-আপ বক্স কিনে দিয়েছিলো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, এতকিছুর পরেও মেয়েটা রাগ করতে পারতো না ঐ বিশ্বাসঘাতকের ওপর। নাছোড় এক শিশুর মতো বিশ্বাস করতে চাইতো আলা একদিন ফিরে আসবে ওর কাছে। আফসোস করতো সেবার বম্বে গিয়ে খোঁজ করতে পারেনি বলে। যেন ওর এক্সিডেন্টটা কিছুই ছিলোনা। হায়দারের মৃত্যুর জন্য অবশ্য নিজেকে ও দায়ী করতো মাঝে মাঝে। তারপর, পাখির নীড়ে ফিরে আসার মতো, ফের শুরু হতো ওর প্রেমিকপ্রবরের কথা



ওর মুখে আলা-নাম শুনতে পেলেই হস্টেলের মেয়েরা হয় দারুণ চটে উঠতো নয় ওর মুখের ওপর হাসতে শুরু করে দিতো। বলতো, আরে পুষ্পা তেরা আলাওয়ালা কিসসা কবকা খতম হো গিয়া। অব কোই নয়া কিসসা শুরু কর, খুশ রহেগী। মুখটা শুকিয়ে যেতো পুষ্পার, তাড়াতাড়ি বলে উঠতো তোমরা আমার আলাকে চেনোনা তাই, ও যেদিন ফিরবে...



(শেষ)

Saturday, September 11, 2010

বাসা

আর মাত্র ক'টাদিন রাতের এই ঘ্রাণ

তারপর এ শহর ফেলে যেতে হবে

এই ঘর, এই গাছ

সবুজের জল পাওয়া বাড়ি

যেখানে যেখানে প’ড়ে আনন্দ-রেখাবের দাগ

ঘুম ভেঙে যে পাতারা টুপটুপ মৃদুশব্দে

রাত্রির বৃষ্টিকথা বলে

যে উদাসী বারান্দায় গুটিসুটি শুয়ে থাকে

মেঘভাঙা উত্তরের রোদ

সেসব মায়াবী চোখে চোখ রেখে

একদিন, আরেকদিনের মতো

ভালোবেসে চলে যেতে হবে